সমকামিতা কী ও কেন?

খাদিজা আক্তার: আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আদালত সমকামিতাকে বৈধ ঘোষণা করে ৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করেন। অথচ এর আগে ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো এবং এ অপরাধের জন্য ১০ বছর শাস্তির বিধানও ছিল। ১৮৬১ সালে, ব্রিটিশ আমলে ভারতে সমকামিতাকে যৌন অপরাধ বলে বিবেচিত করা হয়।

সমকামিতার পক্ষে এ রায়ে ভারতবাসীর খুব ছোট একটা অংশ খুশি হলেও অনেকে মনে করছেন পশ্চিমা দেশগুলোকে অনুসরণ করতে গিয়েই তাদের সমাজে আজ নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সমকামিতার পক্ষে এ রায়ের প্রতিষ্ঠা।

যাক ভারতের এ রায় নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তাদের দেশ তাদের স্বাধীনতা আর রুচির বহিঃপ্রকাশ। তবে একটু যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না তা নয়। কারণ, পশ্চিমা হাওয়া যদি দক্ষিণে বয়ে যায় এবং প্রভাবিত হয় জীবনধারা তাহলে দক্ষিণের হাওয়া প্রতিবেশী দক্ষিণীয় দেশ বাংলাদেশেও বইতে পারে এবং প্রভাবিত হতে পারে আমাদের দেশের মানুষের জীবনধারা।

এবার আসি মূল শব্দে। সমকামিতা বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? সমকামিতা বলতে বোঝায় সমলিঙ্গের দুই ব্যক্তির মধ্যে প্রেম কিংবা যৌন আচরণ। প্রবৃত্তি হিসেবে সমকামিতা বলতে বোঝায় মূলত সমলিঙ্গের কোনো ব্যক্তির প্রতি জেগে ওঠা এক যৌন, স্নেহ বা প্রণয়ঘটিত এক ধরনের স্থায়ী প্রবণতা। Wikipedia মতে, Homosexuality is romantic attraction, sexual attraction or sexual behavior between members of the same sex or gender. As a sexual orientation, homosexuality is an enduring pattern of emotional, romantic and sexual attractions. সমকামিতার বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন Gay বা পুরুষ সমকামী, Lesbian বা নারী সমকামী, Shemale বা হিজড়া, Bisexual বা দ্বৈত যৌন জীবন।

সমকামিতা শব্দটি শুনলেই যৌনবিকৃতি বলে আরও একটি শব্দ চলে আসে, অনেকের মতে। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্মে সমকামিতাকে যৌনবিকৃতি হিসেবে নেতিবাচকভাবে বিশ্লেষণ বা চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই গত কয়েক দশক ধরে লক্ষ করা যায় যে, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে রক্ষণশীল সমকামিতাবিরোধী এবং একই সঙ্গে সংস্কারবাদী সমকামিতা সমর্থন উভয় প্রকার আন্দোলন চলছে।

আর সেই আন্দোলনের ফলস্বরূপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এখন সমকামিতাকে বৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে এবং সামাজিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি দিয়ে আইনও পাস করা হচ্ছে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনো এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং কোথাও কোথাও এ অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার দেওয়া হলেও নৈতিক অবক্ষয়ভিত্তিক বিধিনিষেধ রয়েছে। ৩৭৭ ধারা মোতাবেক সমকামিতা শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ, যার শাস্তি ১০ বছর থেকে শুরু করে আজীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানাও হতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে সমকামিতা একটি বিষয় যা সমাজ এবং রাষ্ট্রকে ভাবিয়ে তুলছে। সমাজে এ শ্রেণির মানুষ আছে সংখ্যায় খুবই নগন্য যা হয়তো কোনো কোনো দেশে কিংবা সমাজে পার্সেন্টিজেও পড়ে না। তারপরও প্রাণীকে নিয়ে ভাবতে হয়, যেখানে মানুষের অধিকার নিয়ে কথা। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জীবন বিধান বা ধর্ম রয়েছে, রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন। এবার আসা যাক ধর্মে। ধর্ম কী বলে? প্রথমে আসি ইসলাম কী বলেছে সমকামিতা সম্পর্কে। ইসলাম ধর্মে Homosexuality বা সমকামিতাকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। লূতের (আ.) কওমকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন যার একটি অন্যতম কারণ হলো সমকামিতা। লূতের কওম বাস করত সোদম বা গোমরাহ শহরে।

পবিত্র কোরআন শরিফে আছে, ‘আমি লূতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বললো-তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ? যা তোমাদের পূর্বে সারা বিশ্বের কেউ করেনি? তোমরা তো কামবশত পুরুষদের কাছে গমন করো নারীদের ছেড়ে। বরং তোমরা সীমা অতিক্রম করেছ।’ (আরাফ ৭:৮১-৮২)

আল কোরআন এবং হাদিসের নানা জায়গায় স্পষ্ট করে সমকামিতাকে নিষিদ্ধ বা হারাম করে দেওয়া হয়েছে। কোরআনে বিভিন্ন সূরা এবং আয়াতে মানুষের সমকামী প্রবণতার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব শাস্তি এবং গজবের কথা বলা হয়েছে। যেমন পাথরবৃষ্টি, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি দিয়ে আল্লাহ তাৎক্ষণিকভাবে সমকামীদের মাটিতে পিষে শায়েস্তা করেন। পৃথিবীতে প্রচলিত জীবন বিধানগুলোর মধ্যে একমাত্র ইসলাম সমকামিতার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। অধিকাংশ মুসলিম দেশে সমকামিতা একটি ক্রাইম এবং এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরব, মৌরিতানিয়া, উত্তর নাইজেরিয়া, সুদান ও ইয়েমেনে সমকামিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

ইসলাম আবির্ভাবের যুগে আরব সমাজে ব্যাপকভাবে সমকামিতার প্রচলন ছিল। সে যুগটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। হিন্দু ধর্মেও সমকামিতার বিধান আছে বলে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ বা বিধান নেই। পুরাণসমূহ হতে জানা যায় যে, দেবতা বিষ্ণু ও মহাদেব শিবের হরিহর রূপে মিলন এই রকম একটি ঘটনার নির্দেশ করে। এখানে বিষ্ণু মোহিনী বা নারী বেশ ধারণ করে শিবকে আকৃষ্ট করে, শিব এই ছলনা বুঝে উঠার আগেই শিবের বীর্য স্থালিত হয় এবং সেখান থেকে অযৌনভাবে আয়াপ্পান নামে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এখানে শিব, বিষ্ণুকে নারী রূপেই দেখেছিলেন। আর যেহেতু পুরাণসমূহ থেকে জানা তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও একে রহস্য বলেই মেনে নিয়েছেন।

তাই বলা যায় এই সনাতন ধর্মের কোথাও স্পষ্ট করে সমকামিতার পক্ষে কিছু বলে নাই, বরং হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমকামিতার জন্য বিভিন্ন শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারী সমকামী এবং পুরুষ সমকামীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বর্ণনা পাওয়া যায়। খ্রিস্টান ধর্মে সমকামিতা নিষিদ্ধ। বাইবেলে সমকামিতা এক ধরনের পাপ বলে বলা হয়েছে। ঈশ্বর সমকামিতার মনোভাব নিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেন নাই। বাইবেলে আছে, লোকেরা পাপের কারণে সমকামী হয় এবং এটা তাদের নিজেদের পাপপূর্ণ ইচ্ছার পরিণতি।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রদেশ ওয়াশিংটন এবং মেরিল্যান্ডে সমকামিতাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হলো দুটি ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের সম্পর্ক যা সমাজ গঠনে সহায়ক। সমকামী বিবাহের মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। সুতরাং সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হলো সমাজকে ভুল পথে চালিত করা। বৌদ্ধ ধর্মে বলা আছে, যেসব ভিক্ষু কামাচার করবেন তারা পারাজিকাগ্রস্ত অর্থাৎ ভিক্ষুত্ব হারাবেন। বৌদ্ধ ধর্ম মতে যেটা সমাজ স্বীকৃত কামাচার তাই বৈধ। যে সমাজে যেটা গ্রহণযোগ্য নয় সেটা বর্জন করতেই বলেছেন বুদ্ধ।

সমকামিতাকে কোনো কোনো ধর্ম মানব জন্মের অন্তরায় হিসেবেও পরিগণিত করে থাকে। সমকামিতায় আসক্ত ছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিরা। যেমন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, আলেকজান্ডার দি গ্রেট, রিকি মার্টিন, ওস্কার ওয়াইল্ড, ফ্রান্সিস বেকন, এরিস্টটল, এলেন গিন্সবার্গ এবং আরও অনেকে। ভারতের বিখ্যাত পরিচালক করন জোহর কিছুদিন আগে অস্পষ্টভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন তার সমকামিতার কথা। তবে যতই বিশ্লেষণ করি না কেন সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এবং সমাজ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে এই সমকামিতার পক্ষে খুব কম সংখ্যক গোষ্ঠী কিংবা দেশ রয়েছে।

অতি আধুনিকতা মানুষকে মাঝে মাঝে বিপথে ধাবিত করে। তা ছাড়া এ সমকামিতার জন্য মরণব্যাধি এইডসের প্রকোপও বেড়ে যাবে। এ পৃথিবীতে জীবনকে সুন্দর করে যাপিত করার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট জীবন ব্যবস্থা রয়েছে, তাই আমাদের সে দিকটায় খেয়াল রাখা উচিত। সমকামিতায় যদি ইতিবাচক দিক থেকে নেতিবাচক দিকটাই প্রস্ফুটিত হয় বেশি তাহলে সে আধুনিকতায় উদার হতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত।

খাদিজা আক্তার: শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী।
khadiza7862@gmail.com