মালয়েশিয়ায় আটক অভিবাসীরা নির্যাতিত, ন্যায় বিচার প্রত্যাশা

মালয়েশিয়ার কারাগারে নির্বিচারে নিরবচ্ছিন্নভাবে আটক হওয়া বাংলাদেশি অভিবাসীরা নির্যাতিত। তাদের ন্যায় বিচার কোথায়? এমন প্রশ্ন ছুড়েছেন তারা। দেশটির বন্দিশিবির ও জেল খানায় আটক থাকা অভিবাসীদের নিয়ে ডেইলী ষ্টারের প্রতিবেদনে বলাহয় ৩০ জুন তারিখে নথিভুক্ত বিদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রায় ছয় মাস আগে বাংলাদেশি হাসান একটি কাজের অনুমতির জন্য আবেদন করেছিলেন।

এর পর হাসান একটি অভিযানে পুলিশের হাতে আটক হন তিনি প্রমাণ করার জন্য সমস্ত বৈধ দলিলপত্র ইমিগ্রেশন পুলিশকে দেখিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক বোঝানোর পরও তাকে ছাড়া হয়নি। ৩ সেপ্টেম্বর পুলিশ তাকে কুয়ালালামপুরের বুকিত বিন্তাং এলাকা থেকে হাসানসহ কয়েকজনকে আটক করে। হাত কড়া লাগিয়ে কয়েক ঘন্টা রোডে বসার জন্য বাধ্য করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। তারপর তাদের একটি ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী মুন্সিগঞ্জের, হাসান বুকিট জলিলের বন্দি শিবিরে তাকে আটক রাখা হয়েছিল দীর্ঘ দিন।

প্রায় এক দশক ধরে মালয়েশিয়ার রাজধানীতে বসবাস তার । অবশেষে বন্দি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলার (প্রায় ১,২০,০০০ টাকা) কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছিলেন। ক্যাম্পের ভেতরে সব বন্দি বস্ত্রহীন অবস্থায় রাখা হয়েছিল। ‘সব ধরনের শ্রমিক ছিল- যারা বৈধ কাগজপত্রসহ এবং ছাড়া। এদের মধ্যে অনেককেই কান ধরে উঠবস করানো হয়।’ হাসান বলেছিলেন, ‘আমি কেন আটক ছিলাম এবং ক্যাম্পের বিষয়ে আমার কোনও ধারণা ছিল না। ক্যাম্পে দায়িত্বরতরা বন্দিদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে।’

‘আমি সাত বছর আগে মালয়েশিয়া এসেছিলাম। আমার নিয়োগকর্তা আমার ভিসা নথিভুক্ত করে। আপনি আমাকে বলুন কি আমার দোষ? ‘বুকিত বিনতাংএর একটি দোকানে কাজ করে হাসান। হাসান প্রশ্ন ছুড়লেন মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীদের ‘ন্যায়বিচার কোথায়? এখানে আমাদের (বাংলাদেশিদের) কোন মর্যাদা নেই বলে মনে করেন তিনি।

হাসানের মতো, অন্যান্য অনেক বাংলাদেশি এ ধরনের আতঙ্ক সহ্য করছেন, কারণ ৩০ জুন পুনর্বাসন কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর মালয়েশিয়া অনিয়মিত অভিবাসীদের ওপর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল ইমিগ্রেশন বিভাগ। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কর্মসূচি চলাকালীন কর্মজীবনের জন্য আবেদন করা সত্ত্বেও তারা সমস্যায় পড়ছে।

ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তাফার আলী বলেন, অভিযান অব্যাহত থাকবে, ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বার্নামার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আটককৃত বাংলাদেশিদের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে ৪ সেপ্টেম্বর মুস্তাফার জানান, জানুয়ারি থেকে ৩০হাজার বিদেশি কর্মীকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬হাজার বাংলাদেশি।

বর্তমানে, প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশে রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক অবৈধ অভিবাসী। তাদের অধিকাংশই কাজের অবস্থা নিয়মিতকরণের জন্য প্রযোজ্য এবং প্রক্রিয়াগুলির জন্য ৬হাজার থেকে ১০হাজার রিংগিট ব্যয় করেন। তবে প্রায় ৮০ শতাংশ এখনো পারমিট না পাওয়াতে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে রয়েছেন।

বেশিরভাগ অভিবাসী এই কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে আসছেন, অভিবাসীরা তাদের নিয়োগকর্তা ও শ্রম দালালের হাত থেকে শোষণের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নথিভুক্ত নন। তারা বলেন, যারা কাজ ও পারমিটের জন্য আবেদনপত্র দাখিল করে তাদের আটক করা অভিবাসন আইনের লঙ্ঘন।

কুয়ালালামপুরে অভিবাসীদের জনপ্রিয় প্রাণকেন্দ্র কোটারায়াতে বসবাসকারী একজন বাংলাদেশি নাইমুল হক বলেন, তাকে ১ জুলাই থেকে ১৭ দিন ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি অত্যন্ত অপমানের সম্মুখীন হন। তিনি বলেন, যদিও এটি তার ছিল কাজের পারমিটের জন্য আবেদন এবং এমনকি সব প্রয়োজনিয় ফি প্রদান। নাঈমুলকে অন্য দুই কর্মীর সঙ্গে আটক রাখা হয়েছিল এবং মেঝেতে বসতে হয়েছিল। তাকে প্রথম দিনে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি। ‘পুলিশ তাদের চারজনকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, পরে চেক করেছিল। তারা আমাদেরকে ৫০ বার কান ধরে উঠবস করিয়ছিল। ‘আমাদের অপরাধ কি ছিল?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। কোন উওর মিলেনি।

এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্ট অনুসারে, দেশে অভিবাসন ক্যাম্প অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক এবং আটক স্থানগুলোর জন্য সর্বনিম্ন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম। অভিবাসন কেন্দ্রে বন্দিদের বিছানা, পরিষ্কার পানি, ওষুধ এবং পর্যাপ্ত খাবার নিয়মিত অক্সিজেনের অভাব। তারা বেশিরভাগ সময় তাদের কোষে ব্যায়াম, সংগঠিত উপাসনা বা অন্যান্য সুযোগ ছাড়াই ব্যয় করে। রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

নাঈমুল বলেন, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও মিয়ানমারের প্রায় ৪হাজার কর্মী ক্যাম্পের ভেতরেই অমানবিক ভাবে বন্দি রাখা হয়েছে। বেশিরভাগ বন্দি বাংলাদেশি ছিল।

মালয়েশিয়ার সব আটককৃত অভিবাসীদের মধ্যে, যাদের কাছে কাজ পারমিটের জন্য আবেদন করা হয়েছে তারা প্রমাণিত হচ্ছে তাদেরকেও অভিবাসন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অন্যরা জেলে আছেন।

জেলখানায় ভয়ংকর পরিস্থিতি
বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি অভিবাসী বলেন, শিবিরের চেয়ে কারাগারে পরিস্থিতি খারাপ ছিল। শহীদুল ইসলাম (৩৩) তার আবেদনপত্রের সব কাগজপত্র থাকলেও তাকে ২০১৬ সালে পাঁচ মাসের জন্য জেলে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাকে পাঁচবার আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার কোনো আইনজীবী ছিল না। পাঁচ মাস পর, আমি মুক্তি পেয়েছিলাম কারণ আমার নথি বৈধ ছিল।

‘তাই, কেন আমাকে রাখা হয়েছিল? সেই পাঁচ মাসের জন্য কারাগারে? কে এই ক্ষতিপূরণ দেবে? ‘১৩ সেপ্টেম্বর সেলেঙ্গার রাজ্যে সাইবারজায়া একটি ফ্যাক্টরিতে কর্মরত শহীদুল ইসলাম এ প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, কারাগারে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ বন্দিকে রাখা হয়েছিল, যার মধ্যে ২৫ জনকে সাময়িকভাবে থাকতে দেওয়া হয়েছিল।’ কারাগারের দিনগুলোতে আমি ফিরে আসার কথা ভাবতাম ও ফিরে আসব না (মালয়েশিয়া)। আমি প্রতি রাতে কাঁদতে থাকি। ‘বগুড়ার শহীদুল বলেন, আমি তখনও মনে মনে নিজের জন্য খারাপ বোধ করি।’

কুয়ালালামপুরের একটি অধিকার সংস্থা উত্তর সাউথ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক অ্যাড্রিয়ান পেরেরা বলেন, অভিবাসীদের নির্বিচারে গ্রেফতার পুলিশের নতুন কিছু নয়। তিনি বলেন, ‘অনেক অভিবাসীরা ধরপাকড়ের কাহিনী আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে ভয় পায় কারণ তারা সাক্ষী সুরক্ষা ব্যবস্থায় আস্থা রাখে না। এমনকি নাগরিক সমাজ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না।’

তিনি বলেন, অভিবাসীদের অবস্থা যাচাইয়ের ঘটনাটি ঘটতে পারে। সুতরাং যারা দস্তাবেজ ধারণ করে তাদেরকে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতার লজ্জাজনক অপব্যবহার ও সরকারি সংস্থার বর্জ্য বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অভিবাসীদের প্রতিকারের জন্য কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করার এবং দুর্নীতি ও অধিকার লঙ্ঘনের চক্রটি শেষ করার জন্য নিরাপদ উপায় খুঁজে বের করা উচিত।

অ্যাড্রিয়ান বলেন, অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী মালয়েশিয়ার পুলিশ কর্তৃক নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি। একজন শ্রমিক নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশিরা অভিবাসন অভিযানে ও কারাগারগুলোতে চিকিৎসা করা হয়, সে বিষয়ে অপমানজনক।

মালয়েশিয়ার ক্ল্যাং এর এমপি চার্লস সান্টিয়াগো অভিবাসীদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছেন। এমপি চার্লস সান্টিয়াগো অভিবাসীদের গ্রেফতার না করে সুষ্ঠু সমাধানের জন্য সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করবেন বলে জানান। এদিকে ভয়ে ভয়ে দিন-কাটানো বাংলাদেশিরা অনেকেই অভিযোগ করছেন কথিত এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হওয়াতেই তারা আজ অবধি সে দেশে বৈধ শ্রমিকের স্বীকৃতি পাননি। ২০১৬র ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার সরকার রিহায়ারিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে এ অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু যে তিনটে ভেন্ডর কোম্পানিকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের নাম ভাঙিয়ে বেশ কিছু নকল এজেন্ট বা দালাল বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিরাট প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।’

খোজঁনিয়ে জানা গেছে, যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা না-বুঝে ওই ভুয়া এজেন্টদের হাতে চার থেকে পাঁচ হাজার রিঙ্গিত ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার রিঙ্গিত তুলে দিয়েছেন, তাদের আঙুলের ছাপও নেওয়া হয়েছে-কিন্তু এজেন্টরা ওই টাকাটা মেরে দেওয়ায় তাদের আর কখনওই বৈধ হয়ে ওঠা হয়নি।