জামাই-শ্বশুরের ‘রিয়াল প্রতারণা’

আবু শেখ পেশায় রঙমিস্ত্রি। আর আবদুর রহমান মোল্লা তার চাচাশ্বশুর। জামাই-শ্বশুর মিলে গড়ে তুলেছেন প্রতারণার এক চক্র। তাদের সহযোগী হিসেবে আছে আবুর শ্যালক ইশারত মোল্লাসহ কয়েকজন। গুলশান-বনানী এলাকায় যানজটে আটকে থাকা প্রাইভেটকার টার্গেট করে তারা। এরপর গাড়ির আরোহীদের কাছে কম দামে সৌদি আরবের মুদ্রা ‘রিয়াল’ বিক্রি করতে চায়। তাদের ফাঁদে পা দেয় অনেকেই। এ সময় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আরেকজন উপস্থিত হয় সেখানে। তার উপস্থিতিতে রিয়াল হস্তান্তর করতে আপত্তি জানায় চক্রের প্রথম সদস্য।

নানা নাটকীয়তার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দেখে ফেলবে- এমন ভয় দেখিয়ে দ্রুত কথিত রিয়াল হাতবদল করে চলে যায় তারা। পরে দেখা যায়, বান্ডিলের ওপরে-নিচে কয়েকটি রিয়াল, আর বাকিগুলো সাদা কাগজ। প্রতারণায় জড়িত চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতারের পর শুক্রবার এসব তথ্য জানায় র‌্যাব-১।

আবু শেখ ও আবদুর রহমান মোল্লা ছাড়া গ্রেফতার অপর পাঁচজন হলো- শাহিন মাতব্বর, মহসিন মিয়া, আবুল বাশার, কামরুল শেখ ও ইশারত মোল্লা। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় তাদের। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেড় হাজার রিয়াল, তিন হাজার ৮২২ টাকা ও ১০টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।

প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানাতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে। এতে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, ‘দেশে রিয়ালের উচ্চমূল্য থাকায় তারা প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে এই মুদ্রা বেছে নিয়েছে। প্রতারণার প্রাথমিক পর্যায়ে আসল রিয়াল ব্যবহার করে তারা। এতে মানুষ আস্থা রাখে তাদের ওপর। এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও অধিকাংশই কাজ করে রঙমিস্ত্রি হিসেবে। বিভিন্ন বাসায় রঙ করার সময় সুযোগ বুঝে বাসার বয়স্ক ব্যক্তিকে রিয়াল দেখিয়ে বিক্রির কথা বলে ফাঁদে ফেলে। এ ক্ষেত্রে তারা সহজ-সরল ও ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের টার্গেট করে। তাদের মতে, এই বয়সের মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির জ্ঞান কম এবং তারা তুলনামূলক কম সন্দেহপ্রবণ হয়। প্রতারক চক্রের প্রত্যেক সদস্যের কাজ ভাগ করা থাকে। তাদের কেউ টার্গেট নির্ধারণ করে, কেউ সরাসরি টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে লেনদেন করে, আবার কেউ লেনদেনের সময় আগ্রহী ক্রেতার ভূমিকা পালন করে।’

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক জানান, চক্রের অন্যতম টার্গেট হজ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হজযাত্রীরা। চক্রের সদস্যরা গ্রাম থেকে আসা হজযাত্রীদের কাছে কম দামে সৌদি রিয়াল বিক্রির প্রলোভন দেখায় হজযাত্রীর ছদ্মবেশে। সাধারণ হজযাত্রীরা যাচাই-বাছাই না করেই তাদের ফাঁদে পা দেন এবং প্রতারণার শিকার হন। এ ছাড়া চক্রের সদস্যরা আগে থেকে টার্গেট নির্ধারণ করেও প্রতারণা করে। তখন তারা বোকা সেজে টার্গেট ব্যক্তির কাছে জানতে চায়, বিদেশি মুদ্রা কোথায় বিনিময় করা যায়? হাতে থাকা রিয়াল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে সেটা কোন দেশের মুদ্রা। রিয়ালগুলো ইজতেমা মাঠে বিদেশি মুসল্লি খুশি হয়ে দিয়েছেন বা কুড়িয়ে পেয়েছে বলেও তারা জানায়। আবার কখনও বিদেশে থাকা আত্মীয়ের কাছ থেকে পাওয়ার কথাও বলে। এক পর্যায়ে যথারীতি কম দামে রিয়াল বিক্রির প্রস্তাব দেয় এবং তার কাছে আরও রিয়াল থাকার কথা জানায়। অধিক লাভের মোহে পড়ে টার্গেট ব্যক্তি তাদের সঙ্গে নির্ধারিত স্থানে যায়। প্রতারকরা সাধারণত বিভিন্ন রাস্তার মোড় বা শপিং মলের মতো জনবহুল স্থান বেছে নেয়। এতে নকল রিয়াল গছিয়ে দ্রুত মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে পারে তারা। লেনদেন এতটাই কম সময়ে ও সূক্ষ্ণভাবে করা হয় যে, টার্গেট ব্যক্তি রিয়াল গুনে নেওয়ার, যাচাই করার বা তাদের প্রতারণা বোঝার সুযোগ পান না। একটু পর যখন বুঝতে পারেন, তখন তার কিছুই করার থাকে না।

র‌্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত আবু শেখ এই চক্রের মূল হোতা এবং শাহিন মাতব্বর ও মহসিন মিয়া তার প্রধান সহযোগী। আবু শেখ পেশায় রঙমিস্ত্রি হলেও মাঝে মাঝে রিকশা চালায়। মূলত টার্গেট খোঁজার জন্য সে এসব কাজ করে।