‘কথা বলতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই’

বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলামকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতারের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। গতকাল মঙ্গলবার সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমেদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিধি অনুসারে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী কোন শিক্ষক গ্রেফতার হলে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার নিয়ম আছে। উনি সরকারের কাস্টডিতে থাকায় কোন একাডেমিক কাজে অংশ নিতে পারছেন না। এজন্যই তাকে এই সাময়িক বরখাস্ত দেখাতে হয়েছে।” “এটা কোন শাস্তি নয়। এটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা। জামিন পাওয়ার পর উনি আবেদন জানালে আবার পুনর্বহাল করা হবে। ”

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটূক্তি করে ফেইসবুকে পোস্ট দেয়ার অভিযোগে গত জুলাই মাসে মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে হাটহাজারি থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার এক সদস্য।

এরপর মাইদুল ইসলামের আইনজীবী ভুলন লাল ভৌমিক উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করলে আদালত আট সপ্তাহের অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন।

সোমবার সেই জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন মাইদুল ইসলাম।

সেখানে তিনি জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন জানালেও মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালত তা নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এ ব্যাপারে আইনজীবী ভুলন ভৌমিক বলেন, “ফেসবুকের যে দুটি পোস্টের জেরে মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী, সরকার প্রধান বা অন্য কারো কোন নাম নেই। ৫৭ ধারার কোন উপাদান এই মামলাতে পড়ে না।”

“ওই ফেসবুক পোস্টে তিনি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মাত্র, যেটা কীনা একজন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। ছাত্রলীগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই মামলাটি করেছে। মাইদুল ইসলাম কোন অপরাধ করেন নাই। আমরা এখন উচ্চ আদালতে তার জামিনের জন্য পুনরায় আবেদন জানাবো।”

ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার কারণে কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে এভাবে গ্রেফতার বা বরখাস্তের ঘটনা এটাই প্রথম নয়।

এর আগেও কটূক্তিমূলক মন্তব্য করায় কারাভোগের পাশাপাশি বরখাস্ত হয়েছিলেন গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক।

একই ধরনের ঘটনায় সর্বশেষ মাইদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্তের যে সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েছে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

তার মুক্তি ও চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে একটি বিবৃতিতে সই করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ জন শিক্ষক।

এ ধরনের “নিপীড়নমূলক চর্চার মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে ভিন্ন মতের দমন করা হচ্ছে” বলে উল্লেখ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা।

তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় হল এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে আমরা স্বাধীন জ্ঞানচর্চা করতে পারবো, যেখানে রাষ্ট্র বা সরকারকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সুযোগ আছে, যেখানে আমরা শিক্ষার্থীদের ক্রিটিকালি দেখার চোখ তৈরি করার কাজ করি। এভাবে শিক্ষকদের গ্রেফতার ও বরখাস্তের মাধ্যমে আমাদের কাজের জায়গা নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।”

মির্জা তাসলিমা সুলতানা আরও বলেন, “আমরা তো শিক্ষার্থীদের তাহলে কিছু শেখাতে পারবো না। এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে সমালোচনার কোন জায়গা রাখতেই দেয়া হচ্ছে না। সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধ করতে চাইছে। কিন্তু এটা না থাকলে যে কোন জায়গা থেকে ক্রুটি হতেই থাকবে। সবধরনের কথা বলার যদি সুযোগই না থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠান থাকার কোন দরকার নেই।”

ওই বিবৃতিতে শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, মামলা দায়েরের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সদস্যরা মাইদুল ইসলামসহ আরেক শিক্ষককে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণার পাশাপাশি তাদের চাকরিচ্যুত করার দাবি জানায়। এমন অবস্থায় ওই দুই শিক্ষক ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হন এবং নিরাপত্তা চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।