সেরাদের নেতৃত্বে নিয়ে আসাই টার্গেট

গোলাম রাব্বানী। ছাত্রলীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক। জন্ম মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। পরিবারেই রাজনীতির হাতেখড়ি। মাতামহ মরহুম সামশুল হক মুন্সী রাজৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্থানীয় ইশিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর এবং শেখ পরিবারের একজন অন্যতম সুহৃদ।

গোলাম রাব্বানীর মা তাছলিমা বেগম রাজৈর কলেজ ছাত্রলীগের সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদকের (১৯৮৩-১৯৯১) দায়িত্বে ছিলেন। নব্বয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন।

ছোটবেলা থেকে রাজনীতি দেখে আসা রাব্বানী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও পাঠচক্র, উপ-আন্তর্জাতিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক ছাড়াও বিভিন্ন পদে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার বাবা এমএ রশিদ আজাদ ভূমি মন্ত্রালয়ের অধীনে কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমানে ফরিদপুরে কর্মরত। একমাত্র ছোট ভাই গোলাম রুহানী সবুজ ৩৫তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে মনোনীত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই ছাত্র একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাছে দীর্ঘ আলাপে তুলে ধরেছেন, ছাত্রলীগ নিয়ে নিজের স্বপ্ন, সমসাময়িক রাজনীতি ছাড়াও নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন জসিম;

দীর্ঘ তিন মাস যাচাই-বাছাইয়ের পর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে নেতা বানিয়েছেন। এশিয়ার বৃহৎ এ সংগঠনের দায়িত্ব পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী?

দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমে যেটি মনে হয়েছে, এখানে ক্ষমতাটা যত বেশি, তার চেয়েও দায়িত্ব বেশি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আমার আবেগ ও ভালোবাসার প্রতিষ্ঠান। এক যুগ এ সংগঠনের সঙ্গে আছি। যৌবনের শ্রম-ঘাম দিয়ে জাতির জনকের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার উপর আস্থা রেখে দায়িত্ব দিয়েছেন, এটি আমার কাছে পবিত্র আমানত। এই আমানতের পবিত্রতা রক্ষার জন্য যদি আমাকে জীবন দিতে হয়, আমি প্রস্তুত। ছাত্রলীগ আমাদের সম্পত্তি নয়, সম্পদ। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এই সংগঠনের মর্যাদা রক্ষা করব।

ছাত্রলীগ নিয়ে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে কি ভাবছেন?

ছাত্রলীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী। তাদের স্বপ্ন, অনুভূতি ও আবেগ নিয়ে অনেক সময় খেলা করা হয়। বঞ্চিত করা হয়, শ্রম-ঘামের মূল্যায়ন হয় না— এসব অপসংস্কৃতি দূরে আপা (শেখ হাসিনা) আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এজন্য আমাদের প্রথম টার্গেট হচ্ছে, প্রত্যেকটা ইউনিটের সবদিক বিবেচনায় সম্ভাব্য সেরাদের নেতৃত্বে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করব। কারো কোনো রিকমেন্ডেশন নেব না। উপরে আল্লাহ, নিচে শেখ হাসিনা, এছাড়া কারো কথা শুনতে আমরা বাধ্য নই। অবশ্যই আমাদের সাবেকরা অভিভাবকতুল্য, ইতিবাচক ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ নেব। কিন্তু, কারো পরামর্শে কোনো যোগ্যকে বাদ দেব না। কারো চাপে নত স্বীকার করে কখনো একজন ত্যাগীর শ্রমকে অবমূল্যায়ন করব না। এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা। একজন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার কোনো ম্যান দরকার নেই। আমি চাই, প্রত্যেকটি ইউনিটে জননেত্রী শেখ হাসিনার আদর্শিক কর্মীরা ছাত্রলীগের কাণ্ডারি হোক। যোগ্যদের যোগ্য স্থানে দেখতে চাই। আপা আমার যোগ্যতার মূল্যায়ন করেছেন, আমি তো সেটার অমর্যাদা করে অন্যের যোগ্যতার অবমূল্যায়ন করতে পারি না। আপা যে স্বপ্ন নিয়ে আমাকে নেতা বানিয়েছেন, আপার স্বপ্ন বাস্তাবায়নে যা প্রয়োজন করব।

ছাত্রদের মধ্যে নেতা হওয়ার জন্য কোন যোগ্যতা থাকতে হবে বলে আপনি মনে করেন?

রাজনীতি করতে হলে আকাশের মতো উদার, সাগরের মতো বিশাল মন প্রয়োজন। আমি গত এক যুগ এ সংগঠনে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছি। নৈতিকতার জায়গায় কখনো আপস করিনি, আপা সেটা মূল্যায়ন করেছেন বলে মনে করি। আমি এই মূল্যায়নের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করব। ছাত্রলীগ করতে হলে যেসব গুণাবলী থাকতে হবে , তা আমি কিছুদিন আগে স্পষ্ট করেছি। আর সাধারণ ছাত্রদের প্রতি আমার বক্তব্য, ছাত্রলীগ সব সময় আউট অব বক্স চিন্তা করবে। কোনো গণ্ডির মধ্যে থাকবে না। যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে থাকবে ছাত্রলীগ। যে কারো ইতিবাচক আইডিয়া, মতামতকে সাদরে গ্রহণ করবে। এই কমিটির স্লোগান হলো; ছাত্রলীগ হবে সকল ইতিবাচকের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। আমরা এ প্রত্যয় নিয়ে কাজ করব। সেবার ব্রত নিয়ে আসছি, যেকোনো সেবামূলক কাজ করব। তাছাড়া আমরা যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত। সাধারণ শিক্ষার্থী এবং গণমানুষের প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে, যেকোনো যৌক্তিক দাবি বা আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রলীগ সব সময় একাত্ম থাকবে। সরকারের সঙ্গে কথা বলে সে দাবি বাস্তবায়নে কাজ করবে। আমরা সরকারের অংশ নই, শিক্ষার্থীদের অংশ। ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন, অর্থাৎ আমরা একই আদর্শের। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শেখ হাসিনার উন্নয়নমূলক জনবান্ধব রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। তাদের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হিসেবে দল, দেশ ও মানুষকে সেবা করতে চাই।

ব্যতিক্রম অর্থই তো সবকিছুতে ভিন্নতা। ছাত্রলীগ যারা করবে, তারা ছাত্রলীগের নানা কর্মসূচিতে অংশ নেবে, এই আদর্শ ধারণ ও প্রচার করবে, এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু, আমরা দেখি নেতাদের পেছনে দিনরাত ছুটছে শত শত শিক্ষার্থী। এটা বন্ধে আপনার পদক্ষেপ কি?

এজন্য আমিও অনেক সময় বিব্রত হই। একটা ট্রেন চললে, বন্ধ করার পরও কিছুদূর যায়। দীর্ঘদিনের একটা সংস্কৃতি চলে আসছে; ভাইয়ের পেছনে ছুটাছুটি, কোনো কোয়ালিটি না দেখে শুধু চেহারা দেখে, কারো রিকমেন্ডেশন শুনে নেতা বানানো, এটা আমরা করব না। তবে একদিনে এই অপসংস্কৃতি বন্ধ করাও সম্ভব নয়। আমি সাবেকদের কথা বলব না। আমার প্রেক্ষাপট বলছি, আপনারা জানেন, সারাদেশের শিক্ষার্থীরাও জানে, দীর্ঘ তিন মাস যাচাই-বাছাই করে নেত্রী কমিটি দিয়েছেন। এটা আপার কমিটি। এই কমিটি নিয়ে অন্যান্যবারের চেয়ে উচ্ছ্বাস, আবেগ ও ভালোবাসা বেশি। যারা আসছে, তারা পদ পাওয়ার জন্য, আমাদের দৃষ্টিআকর্ষণ করতে আসছে, বিষয়টা সব ক্ষেত্রে এমন না। তারা তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে আসছে। ছাত্রলীগের বাইরেও যারা ইতিবাচক মানসিকতা লালন করে, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও আমার কাছে আসছে, তারা বলছেন, আপনাদের শুভ কামনা জানাতে এসেছি। তারপরও আমরা একটা বার্তা দিয়ে দিয়েছি, আমরা কারো চেহারা দেখে নেতা বানাব না। যোগ্যতার মূল্যায়ন করব। আপনারা আমাকে এ বিষয়ে তখনই প্রশ্ন করবেন, যখন দেখবেন আমি যোগ্যতার মূল্যায়ন না করে চেহারা দেখে বা ‘গিভ অ্যান্ড টেকের’ মাধ্যমে নেতা বানিয়েছি।

নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর আপনার পরিকল্পনা কী? ছাত্রলীগকে কীভাবে ঢেলে সাজাবেন। আর সংগঠন ও দেশের মানুষের জন্য কী করবেন?

২৯তম জাতীয় সম্মেলন জননেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও তার পছন্দে হয়েছে। তার আশির্বাদপুষ্ট যে নেতৃত্ব আসছে, তাদের মাধ্যমে ছাত্রলীগে ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারাটা শুরু করতে চাই।

এখন সিটিজেন জার্নালিজমের যুগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে বিস্তৃতি, একে কাজে লাগিয়ে আমাদের বিরোধী শক্তি ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, কতিপয় দিকভ্রান্ত বাম, এদের সমন্বিত অপশক্তি সব সময় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে ছাত্রলীগকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে চায়। কারণ, তারা জানে, শেখ হাসিনার আবেগের জায়গা ছত্রলীগ। ছাত্রলীগকে দুর্বল করা গেলে শেখ হাসিনাকে দুর্বল করা যাবে, সরকারকে ‍দুর্বল করা যাবে। এজন্যই বারবার ছাত্রলীগ তাদের কলম সন্ত্রাস ও গুজবের শিকার। ছাত্রলীগের সঙ্গে মাঠের রাজনীতিতে বা আন্দোলন সংগ্রামে টিকতে না পেরে, তারা বেছে নিয়েছে এই অন্ধকার চোরাগলির পথ। অর্থাৎ মিথ্যা, বানোয়াট বিভ্রান্তিকর কিছু তথ্য তারা অনলাইনে ছড়িয়ে, ইউটিউবে ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে, ফটোশপ করে কিছু ছবি বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সারাদেশের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাজে লাগিয়ে মাঠের রাজনীতির পাশাপাশি অনলাইনেও ছাত্রলীগকে সচেতন করতে ও কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে আমরা একটা উদ্যোগে নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী তনয় ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার সজীব ওয়াজেদ জয়ের দেখানো পথেই হাঁটতে চাই। সে আলোকে ইতোমধ্যে আমরা আলোচনা করেছি, অনলাইনে বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার।

‘বঙ্গবন্ধু সাইবার বিগ্রেড’ কি এজন্যই?

হ্যাঁ, এই প্রজেক্টের একটি হলো, সারাদেশের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে আমরা ‘বঙ্গবন্ধু সাইবার ব্রিগেড’ (বিসিবি) করছি। ইতোমধ্যে প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছি। এক মাসের মধ্যে একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক ও আইটি সম্পাদকের সরাসির মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সিভি নিয়ে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বাছাই করে একটা সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ) করব। এই ইউনিটটা আমরা সরাসরি তত্ত্বাবধায়ন করব। তারা কনটেন্ট ডেভেলপ করবে; বিভিন্ন পজিটিভ ক্যাম্পেইন, নেগেটিভ অপপ্রচারের জবাব দেয়া এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ করতে বিভ্ন্নি কন্টেন্ট বানাবে। আমরা এগুলো প্রচার করতে প্রতিটি জেলা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি থেকে কিছু লোককে বাছাই করে অনলাইনে দক্ষদের রুটিন মাফিক কাজে লাগাব। আমরা পানির মতো করে একটা প্ল্যাটফর্ম করব, এই নেটওয়ার্কিং সিস্টেমে প্রতিটি ওয়ার্ড-ইউনিয়নের কর্মীরা পর্যন্ত আমাদের কন্টেন্টগুলো পাবে। শিগগিরিই এটার কার্যক্রম আপনারা দেখতে পারবেন।

আর কি কি করছেন?

আমরা ছাত্রলীগের নিউজ পোর্টাল করতে চাচ্ছি। bslnews.com or .net যেটা পাই করব। আমরা একটা খসড়াও করেছি। এর উদ্দেশ্য হবে; মিডিয়াকর্মী, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষিীরা ছাত্রলীগের যেকোনো অথেনটিক নিউজ বা কর্যক্রম পাবে। আমরা এই পোর্টালটি চালাতে নিজস্ব কিছু লোক নিয়োগ দেব। এতে আওয়ামী লীগের পজিটিভ কাজগুলো প্রচার, আমাদের কেন্দ্রীয় ইউনিট, জেলা ইউনিটগুলোর কার্যক্রম প্রচার হবে।

এছাড়া শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে Bslnews এর সাব-ডোমেন হিসেবে বিএসল ক্যারিয়ার ও বিএসএল এডুকেশন করব। বিএসএল এডুকেশনে একটা ছাত্রের ক্লাস ফাইভ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত যেকোনো ধরনের এডুকেশনাল মেটেরিয়ালস থাকবে। উদাহরণ; ধরেন ভর্তি কোচিংয়ে শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার টাকা খরচ করছে, আমরা সে কোচিং বিএসল এডুকেশনের মাধ্যমে ফ্রি দেব। ভিডিও লেকচার থাকবে, পিডিএফ শিট দেয়া হবে। তারা এখান থেকে নিয়ে সরাসরি পড়তে পারবে। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এটা আমাদের ছাত্রলীগের পজিটিভ ব্রান্ডিংয়ের জন্য মাত্র। এ রকমভাবে ক্যারিয়ার গঠনে পরামর্শসহ নানা সহায়তা দিতে বিএসএল ক্যারিয়ারও থাকবে।

এটা আমাদের আগামী ছয় মাসের প্ল্যান। এরপর যেকোনো ইতবাচক ও কল্যাণকর কাজ সামনে আসবে, ছাত্রলীগ সেটা সাদরে গ্রহণ করবে।