শিল্পীরা টাকা চিনতে শিখেছে: মিশা

মিশা সওদাগর নামটা মানেই আতঙ্ক? না, আসলে তা নয়। চলচ্চিত্র জগতে মিশা সওদাগরের প্রথম নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটলেও পরবর্তীতে রূপালী পর্দার দু্ষ্টু লোক খলনায়ক মিশা সওদাগর হিসেবেই তিনি প্রতিষ্ঠা পান। প্রায় তিন যুগ ধরে খ্যাতিমান সব নায়কের সাথে একমাত্র দাপুটে ভিলেন মিশা, যিনি এ যাবৎ তার শক্তিশালী অভিনয়ের মাধ্যমে এখনো নিজের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছেন। তার বাবা মায়ের দেয়া নাম শাহিদ হাসান। বাস্তবে তিনি চমৎকার ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, সদালাপী, অমায়িক, ধর্মপরায়ণ, মানবহিতৈষী ও বন্ধুপ্রিয় লোক।

শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর এ দেশের বাংলা চলচ্চিত্রকে টিকিয়ে রাখতে নানা প্রতিবন্ধকতার সত্ত্বেও আন্দোলনের মাধ্যমে পাইরেসি বন্ধ, যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা পরিবর্তনসহ অনেক ক্ষেত্রে তার অবদান চলচ্চিত্রের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।

চলচ্চিত্র জগতে কবে, কীভাবে এলেন?

১৯৮৬তে তথ্য মন্ত্রণালয় এবং এফডিসি আয়োজিত নতুন মুখের সন্ধানে আমি নায়ক হিসেবে সিলেক্ট হই। তারপর আমি দুটো ছবি করি। একটা হচ্ছে ‘চেতনা’ আরেকটা ছিল ‘অমরসঙ্গী’। তারপর থেকেই পথ চলা। এভাবেই ফিল্মে আসা।

বর্তমানে ব্যস্ততা কেমন? কয়টা ছবি হাতে আছে?

ঈদের ছবি নিয়ে ব্যস্ততা আছে। চারটে ছবি আসবে ঈদে। সাকিব খানের সাথে প্রায় দেড় বছর পর আবার কাজ শুরু করলাম। ভাল স্ক্রিপ্ট পাইনি, তাছাড়া কাজ আমি এমনিই কমিয়ে ফেলেছি। শিল্পী সমিতির সভাপতি হিসেবে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সব মিলিয়ে কাজতো অনেক করেছি, সেই তুলনায় তো আমাদের কারুকাজ কম। তো কারুকাজের জন্য হোক বা আমার ব্যক্তিগত পছন্দের কারণেই হোক, আসলে আমি চাই ছোট-বড় যে ক্যারেক্টারই হোক স্ক্রিপ্টটা যেন ভাল হয় যাতে আমার দর্শকদের আমি খুশি করতে পারি। তাছাড়া আমি এতো কাজ করেছি যে ভেরিয়েশন ছাড়া আমার আর কাজ করতে ইচ্ছে করে না। এজন্য আমি কাজের পরিমাণটা কমিয়েছি। তুলনামূলক ভাবে বর্তমানে ছবি নির্মাণও কম হচ্ছে।

কোন বিষয়টা দেখে সিলেক্ট করে থাকেন কাজটা করবেন কি করবেন না?

আগে তো তেমন কোনো বাছ-বিচার করিনি। আমি প্রায় আট নয়’শ ছবিতে কাজ করেছি। এখন মনে হয় স্ক্রিপ্ট ভাল না হলে কাজ করবো না। এখন দেখি স্ক্রিপ্টে আমার চরিত্রটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং যিনি ডিরেকশন দেবেন তার মেধা কত বেশি।

বলছিলেন যে শাকিব খানের সাথে দেড় বছর পরে ছবি করছেন। এই গ্যাপ কেন?

শাকিব যেগুলো বাইরের ছবি করছিলো, ওগুলো যৌথ প্রযোজনার। ওগুলোর সবকটায় আমার অফার ছিল। জাজ মিডিয়ার আজিজ সাহেব সবগুলো ছবিতে আমাকে অফার দিয়েছেন। আমি যেহেতু এ দেশের মানুষ, এ দেশের প্রেম ভালোবাসা বেড়ে উঠা মানুষ। কাজেই সব অফার নৈতিক দৃষ্টিকোন থেকেই রাখা সম্ভব হয় না। যৌথ প্রযোজনা যে ভুল ছিল সেটা আন্দোলন করে প্রমাণ করে দিয়েছি এবং সরকার ওটা চেঞ্জ করে দিয়েছে। তার মানে আই ওয়াজ রাইট। তো সেই জায়গা থেকে তখন শাকিব যে ছবিগুলো করছিলো এবং আমি করিনি একারণে, প্রথমত আমার স্ক্রিপ্টও পছন্দ ছিল না, দ্বিতীয়ত ও বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান ছবি করছিলো। যেগুলো আমার ব্যক্তিগত কারণ মনে করলে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা, ভুল নীতিমালাতে ছবিগুলো হচ্ছিলো। বৈধ ছিল না, ঠিক ছিল না। এ কারণেই আমার ছবি করা হয় নাই। আর কিছু না।

এখন শাকিব খানের সাথে তাহলে আবার নতুন করে করতে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই?

নতুন পুরানের কিছু নেই। শাকিবের সাথে তো আমার শত শত ছবি। আমি আর শাকিব থাকলে অডিয়েন্স পছন্দ করে। আমাদের রসায়নটা খুব সুন্দর। যে ছবিতে শাকিব আর আমি থাকি, সেই ছবিতে হিরোইন প্রয়োজন হয় না। শাকিবের আর আমার সব ছবিগুলোর গল্প আমাকে আর শাকিবকে কেন্দ্র করে। আমি আর শাকিব ইনশাআল্লাহ দশ পনেরো বছর টানা কাজ করে অডিয়েন্সকে রাখলাম।

এবারের ঈদে আপনার কোন ছবিটা যাচ্ছে?

ঈদে যাচ্ছে ‘ক্যাপ্টেন খান’।

ছবিটা নিয়ে কতটুকু আশাবাদী?

ছবিটা নিয়ে আমি আশি ভাগ আশাবাদী। এ ছবির যে প্রযোজক শাপলা কথা চিত্রের সেলিম ভাই। তিনি অসম্ভব ভাল ছবি বানিয়েছেন।

কোন ছবিগুলো আপনাকে মিশা সওদাগর হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে বলে মনে করেন?

‘স্বামী কেন আসামি’, ‘নুরা পাগলা’, ‘জ্যান্ত কবর’, ‘প্রিয়া আমার প্রিয়া’, ‘নিঃশ্বাস আমার তুমি’, এরপর ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি- ‘বস নম্বর ওয়ান’, ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’, যদিও ছবিটা খুব মার্কেট পায়নি তারপর আমার মনে দাগ কেটে আছে এমন একটি ছবি, ‘ভালোবাসার গল্প’। এমন অনেক অনেক ছবি আছে।

ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোন কোন ছবিতে পেয়েছেন?

২০১২তে পেয়েছি বদিউল আলম খোকন পরিচালিত ‘বস নম্বর ওয়ান’ ছবিতে। আমি আর সাকিব। এরপর ‘সানিয়াত’ সিনেমায় পেয়েছি ২০১৪তে।

খলনায়ক হিসেবে যে কাজ করছেন দীর্ঘ সময়। এটা কি আপনার নিজের ইচ্ছে থেকে?

না আমার ইচ্ছে থেকে না। ‘চেতনা’ আর ‘অমরসঙ্গী’র পর ভিলেন হিসেবে আমাকে ফার্স্ট অফার করলেন আমার ওস্তাদ ছটকু আহমেদ ‘আশা ভালোবাসা’ ছবিতে। সালমান শাহ্‌, শাবনাজ এবং আমি। ওটায় মেইন ভিলেন ছিলাম। ছবিটা মোটামুটি হিট কিন্তু আমি সুপারহিট হয়ে গেলাম।

পর্দার মিশা আর বাস্তবের আপনি নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

যখন অভিনয় করি তখন আমি ১০০% পেশাদার। অভিনয়ের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি। সবার একটাই কথা, আমার অভিনয়কে অভিনয় মনে হয় না কেন! আসলে আমিতো অভিনয়কে অভিনয় ভেবে করি না। ক্যারেক্টারের সাথে একাকার হয়ে যেতে হয় তখন। ভিলেনদের চরিত্র এভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয় যে তার চরিত্র স্খলন থাকবে, তার মতাদর্শ থাকবে না, অনৈতিক, তার সব চাই ই চাই, এটা সমাজের বাজে লোকের সিম্বল। অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আমরা কিন্তু সোসাইটিকে ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছি যে এসব বাজে কাজ, পরাস্ত তুমি হবেই, অধঃপতন তোমার হবেই, তোমরা এসব করো না। আবার নায়কের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আমরা দেখাচ্ছি অলওয়েজ সত্যের জয়, ভাল ছাত্র, পরোপকারী, প্রতিবাদী এভাবে পজিটিভ দিক দেখানো হয়।

পর্দায় আমি মিশা সওদাগর কিন্তু আমার বাস্তব নাম হচ্ছে শাহিদ হাসান। শাহিদ হাসান কিন্তু এরকম পেশাদার না। এখানে ইমোশন কাজ করে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে পছন্দ করি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে গরুর দুধের চা খাই। আমার বাহান্ন বছর বয়সে আমি কখনো সিগারেট খাইনি। আল্লাহ আমাকে দু’বার হজ করার তওফিক দিয়েছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুব হ্যাপি। আমার ওয়াইফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স এবং সে শিক্ষয়িত্রী। আমার দুই ছেলে স্কলাসটিকায় পড়ে। খুব সাধারণ ফ্যামিলিতে জন্ম আমার। টাকাপয়সা না, সম্মানটা আমাদের কাছে অনেক বড় বলেই ছোটবেলা থেকে মা শিখিয়েছিলেন, যে কোনো মূল্যে নিজের চরিত্রটা ঠিক রাখতে হবে।

শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর। কেমন চলছে সমিতির সাংগঠনিক কার্যক্রম?

আপনারা জানেন আমি সভাপতি থাকাকালীন কি কি কাজ করেছি। আন্দোলন করে ছবির যৌথনীতির নীতিমালা চেঞ্জ করে দিয়েছি। আমি কেস খেয়েছিলাম। হল মালিকেরা আমাকে বয়কট করেছিল, মিশা সওদাগরের ছবি হলে চালাবো না। এখন শক্তিশালী উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করেছি, আমরা ফান্ড গঠন করেছি, দুস্থ শিল্পীদের সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছি। তেশরা এপ্রিল আমাদের চলচ্চিত্র দিবস যা আমরা শিল্পী সমিতি উদযাপন করি। এরপর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণীতে আমাদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি থাকে। আমাদের শক্তিশালী প্যানেল আছে একটা যেখানে রোজিনা, অঞ্জনা, পপি, পূর্ণিমা, ফেরদৌস, রিয়াজ, জায়েদ খান, নীরবের মত অভিনেতারা আছেন।

চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ কি আর কখনও ফিরে আসবে বলে মনে করেন?

আমি নিজে তো স্বর্ণযুগ দূরের কথা, রূপা যুগও পাই নাই। তবে তাম্র যুগ পেয়েছিলাম মনে হয়। এখনকার কথা কি আর বলবো! আসলে আমাদের আগের প্রজন্মের শিল্পীরা শিল্পকে ভালোবাসতো আর আমাদের সময় থেকে শিল্পীরা শিল্পকে নয় টাকাকে ভালবাসতে শিখেছে। এখন শিল্প বাদ দিয়ে বাণিজ্য চলে আসছে। আবার এও সত্যি ভালো বাজেট ছাড়া ছবি বানাবে কীভাবে! ইন্ডিয়ায় যে টাকায় একটি ছবি নির্মাণ হয়, ওদের চায়ের টাকায় আমাদের এখানে ছবি তৈরি করা হয়। আরেকদিকে শিল্পী সঙ্কট, মেধাবী পরিচালক তৈরি হচ্ছে না, সিনেমা হল সঙ্কট, নানারকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাদের পরিচালকরা তারপরও চেষ্টা করে ছবি বানাতে, শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে।

এতোটা সময় দেবার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।