খতচিহ্ন নিয়েই ফিরছেন তাঁরা

গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়া নারীদের কেউ ফিরেছেন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়, কারও শরীরে আঘাত ও যৌন নির্যাতনের চিহ্ন। অনেকে সেখানে ঠিকমতো বেতন পাননি, নিয়মিত খাবারও জোটেনি। সৌদিফেরত বেশির ভাগ নারী অভিযোগ করেছেন, সেখানে থাকার সময় প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা পাননি তাঁরা।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন দেড় হাজার নারী কর্মী। এরপরও সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সৌদি আরবে গৃহশ্রমিক হিসেবে নারীদের পাঠানো নিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে।

সৌদিফেরত নারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কে নারীদের তথ্য রাখা শুরু হয়েছে। এই ডেস্কের তথ্য বলছে, গত ১ মে থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রায় তিন মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১ হাজার ৬৩ নারী গৃহকর্মী ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে সৌদিফেরত নারীর সংখ্যাই বেশি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সৌদি আরবের সমঝোতা হয়। এরপর দেশটিতে নারী শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে নির্যাতন ও নিপীড়নের কিছু ঘটনায় অনেকে ফেরত এসেছেন।

সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে কত কর্মী গেছেন, কতজন স্বেচ্ছায় বা সরকারের সহযোগিতায় ফিরে এসেছেন, কতজন বিদেশে অবস্থান করছেন এবং শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির শিকার হওয়া কর্মীর তথ্যসহ তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৩১ জুলাই হাইকোর্ট প্রবাসীকল্যাণসচিব, পররাষ্ট্রসচিব, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বায়রার সভাপতি-সেক্রেটারিকে হলফনামা আকারে আলাদাভাবে ওই সব তথ্যসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন।

জনস্বার্থে রিটটি করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, হাইকোর্ট তালিকা-সংবলিত প্রতিবেদন দাখিল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ওই প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। হাইকোর্টের অবকাশ শেষে ১ অক্টোবর নিয়মিত আদালত বসবে। তখন রুল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।

অভিযোগ রয়েছে, সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলে বা কোনো সমস্যায় পড়লে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতা পান না। সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে ব্র্যাকের কাছে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় কয়েকজন নারী জানান, তাঁরা প্রায় ৫০ জন নির্যাতনের শিকার হয়ে দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলে সৌদি আরবের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।

এ বিষয়ে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেন, ওই নারী কর্মীদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর জন্যই সৌদি আরবের একটি প্রতিষ্ঠানে (সেফ হোম) পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। তিনি বলেন, নারী গৃহকর্মীরা যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই এখানে আসছেন। ভাষা না বোঝা এবং পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে অনেকে স্বেচ্ছায় দেশে চলে গেছেন।

দূতাবাস সূত্র জানায়, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ফেরত এলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে (রিক্রুটিং এজেন্সি) ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওই দেশের মালিককে আরেকজন নারী শ্রমিক পাঠাতে হয়। অথবা নারী শ্রমিককে নেওয়ার জন্য মালিক যে টাকা দিয়েছিলেন, তা পরিশোধ করতে হয় এজেন্সিকে। ফলে নারী শ্রমিকেরা বিপদে পড়লে তখন আর রিক্রুটিং এজেন্সিকে পাশে পাচ্ছেন না।

সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা এক নারীর বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে। গত ১৭ জুলাই সিঙ্গাইর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর খাবার চাইতে গেলেই মালিক মারধর কতেন। গত জুলাইতে ফেরত আসা সিঙ্গাইরের আরেক নারীর বাড়িতে গেলে তাঁর স্বজনেরা বলেন, তিনি (নারী) মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, গত জুন ও জুলাই মাসে তাঁদের হাসপাতালে মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা সৌদিফেরত চারজন নারী চিকিৎসা নেন।

ফেরত আসা একাধিক নারী বলেন, সৌদি মালিকের বাড়িতে যাওয়ার পরপরই তাঁদের কাছে থাকা পাসপোর্টসহ যাবতীয় জিনিসপত্র রেখে দেওয়া হয়। দেশে থাকা স্বজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য শুধু একটি নম্বরে ফোন করতে পারতেন তাঁরা। ফলে দূতাবাস বা বিএমইটিতে নির্যাতনের অভিযোগ জানানো সম্ভব ছিল না।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার বলেন, নির্যাতনের খুব বেশি ঘটনা ঘটেনি। বেশির ভাগ নারী শ্রমিক প্রশিক্ষণ না নিয়েই সৌদি আরব চলে যাচ্ছেন। ভাষা না জানা বা বুঝতে না পারার কারণেও অনেকে সেখানে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশিক্ষণের জন্য সরকার নতুন নীতিমালা করেছে।

গত জুন মাসে ব্র্যাকসহ মোট ১১টি বেসরকারি সংগঠন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একটি স্মারকলিপি দেয়। এতে ফেরত আসা নারীদের নির্যাতন ও নিপীড়নের কথা তুলে ধরা হয়।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, সৌদিতে বিপদে পড়লে সরকারের পক্ষ থেকে নারী কর্মীদের জন্য পরামর্শ-সহায়তা পাওয়ার তেমন কোনো উপায় নেই। অথচ নারীরা ফেরত এলে সরকার সব দায় চাপাচ্ছে এজেন্সির ঘাড়ে। (নিউজ দৈনিক প্রথম আলোর)