উপমহাদেশের বিভক্তি এবং গান্ধি

সা কা ম আনিছুর রহমান খান : মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ( ১৮৬৯খ্রিঃ-১৯৪৮ খ্রিঃ) বিশ্বাস করতেন মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্ম পরিব্যাপ্ত থাকায় রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা হলে রাজনীতি হয়ে যায় নিষ্প্রাণ। কারণ ধর্ম মানুষের ক্রিয়াকর্মের নৈতিক ভিত্তি, জীবন থেকে ধর্মকে বাদ দিলে সে জীবন হয়ে যায় অর্থহীন। তাঁর উপলব্ধিতে ছিল ‘স্রষ্টাই পরম সত্য এবং সত্যই মানব মুক্তির একমাত্র পথ‘।তিনি বিশ্বাস করতেন জনসাধারণের সম্মতিভিত্তিক শাসন ব্যবস্থায় । জনসমর্থন ছাড়া স্বৈরাচারী সরকারও টিকে থাকতে পারে না। জনগণের মন থেকে স্বৈরাচারী শাসক সম্পর্কে ভয় দূরীভূত হলেই ঐ শাসকের ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়ে যায়। এই স্বৈরশাসক মহৎ হলেও তার দ্বারা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। তিনি ব্যক্তি সত্ত্বার পূর্ণ বিকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। মানুষের সমতায় তার আস্থা ছিল অবিচল। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে অহিংসার পথকেই তিনি শ্রেষ্ঠ পথ বলে বিশ্বাস করতেন। তাঁর এই বিশ্বাস তাঁকে দেশে বিদেশে খ্যাতিমান করে। এই খ্যাতি প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে এবং যুগ যুগান্তরেও বহমান। ভক্ত অনুরক্তদের মাঝে তিনি ‘মহাত্মা‘ নামে পূজিত। তিনি স্বাধীন ভারতবর্ষে ‘রাম রাজত্ব‘ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান এবং এই মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। তাঁর এই আহ্বান মুসলমানদের মাঝে আতংক সৃষ্টি করেছিল ।বৃটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে ‘বৃহত্তর বাংলা ‘ গঠনের প্রস্তাব তাঁর কাছে সমর্থন পাবার জন্য উপস্থাপন করা হয়। তিনি এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করেন। সেই সাথে তিনি প্রস্তাব উপস্থাপনকারী শরৎ বসুকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। ফলে সাম্প্রদায়িক মৈত্রীর ভিত্তিতে ‘বৃহত্তর বাংলা’ গঠনের উদ্যোগ বিফল হয় । ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগষ্ট তারিখে ভারত ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান হয়। ঐদিন মিঃ গান্ধী কলকাতায় অবস্থান করছিলেন।‘বৃহত্তর বাংলা’ গঠনের অন্যতম প্রস্তাবক জনাব আবুল হাশিম তাঁর সোদপুর আশ্রমে তাঁর সাথে দেখা করতে যান। তিনি স্বভাবত বেতের মাদুরে বসে ছিলেন । আবুল হাশিমকে দেখে তিনি উচ্চস্বরে হাসেন এবং বলেন “ হাশিম তুমি পরাজিত হয়েছো। …তুমি বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে পারলে না এটা তোমার পরাজয় ।“ এই সময় কথা প্রসঙ্গে মিঃ গান্ধী বলেন “ পৃথিবী জানে সরদার প্যাটেল ‘আমার আজ্ঞাবহ ব্যক্তি’ , কিন্তু ইদানিং আমি যা কিছু বলি তিনি তাতেই ‘না’ বলেন । বাবু রাজেন্দ্র কুমার প্রাতঃভ্রমণে আমার সঙ্গে থাকেন । কিন্তু যখনই আমি আশ্রমে ফিরে আসি আমার মনে হয় যেন আর আমাদের দেখা হবে না । পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু সত্যই জওহার , কিন্তু আবেগ উচ্ছাসের বশবর্তী হয়ে কখনো কখনো এমন কথা বলেন যেটা তাঁর বলা উচিত নয় ।কিন্তু তাঁর ভুল যদি তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তিনি তাঁর ভুল স্বীকার করে নেবার সাহস রাখেন । এসব দেখার জন্য আর কতদিন আমি জীবিত থাকবো।“ আবুল হাশিমের মতে এসব নেতাগণ ‘গান্ধীর আদর্শকে কখনোই গ্রহণ করতে পারেনি; শুধু নিজেদের উচ্চাকাংখাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তাঁকে নেতা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ।‘ মিঃ গান্ধী ‘এটা খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং এখানেই তাঁর সারাজীবনের যে সংগ্রাম তার পরাজয় হয়েছিল।’ এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে আবুল হাশিম আরও বলেন “… আমি গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম পাকিস্তানের বদলে আজ জিন্নাহ যদি তাঁকে ১৪ দফার প্রস্তাব দেন তাহলে তাঁর মনোভাব কী হবে । তিনি বলেছিলেন ‘হাশিম , আমি খুব সাগ্রহে তা গ্রহণ করবো ।’ শ্রদ্ধার সঙ্গে ও বিনম্র স্বরে আমি মন্তব্য করলাম ‘মহাত্মাজী , আপনাকে তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, আপনি যখন জিন্নাহর চৌদ্দ দফা অগ্রাহ্য করেছিলেন সে সময় ১৫ই আগষ্ট , ১৯৪৭ আপনার দৃষ্টিগোচর হয়নি।’ ” [ সূত্রঃ আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি –আবুল হাশিম , পৃষ্ঠা ১৬৬-১৬৭] । ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগষ্ট ভারত ইউনিয়ন বৃটিশ রাজের প্রত্যক্ষ শাসন থেকে মুক্ত হবার পর দিল্লীসহ সারা ভারতে মুসলমান নিধনযজ্ঞ শুরু হয় । প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এই সময়ে বলেন ‘মুসলমানরা যেভাবে কুকুর বেড়ালের মতো খুন হচ্ছে’ তাতে তাঁর পক্ষে দিল্লীতে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মিঃ গান্ধী এই দাঙ্গা বন্ধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে বিফল হন । দাঙ্গা বন্ধের আহ্বান করায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল অনেক কড়া কথা শোনান মিঃ গান্ধীকে।সর্দারজী বলেন মুসলমানদের অভিযোগ করার বা ভয় পাওয়ার কোনই কারণ ঘটেনি। অবশেষে মিঃ গান্ধী তাঁর শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেন। ১৯৪৮খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারী তারিখে তিন ‘অনশন’ শুরু করেন। প্যাটেলের মনোভাবই ছিল এই অনশনের লক্ষ্যস্থল । তিনি দাবী করেন, ‘ হিন্দু আর শিখদের এই হামলায় যে মুসলমানেরা দিল্লী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে তাদের সবাইকে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং তাদের নিজের নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে এনে বসাতে হবে।’ এই শর্ত পূরণ হলে তিনি ‘অনশন’ ভঙ্গ করবেন বলে ঘোষণা দেন। এটা ‘অতি সুচারু ও মহৎ প্রস্তাব’ হলেও এর বাস্তবায়ন এ সময় সহজ ছিল না। অতঃপর ব্যাপক আলাপ আলোচনার পর তিনি অনশনভঙ্গের জন্য নিম্ন বর্ণিত লিখিত শর্ত আরোপ করেন।

১) হিন্দু আর শিখদের এই মুহূর্তে মুসলমানদের ওপর সমস্ত রকম আক্রমণ বন্ধ করতে হবে এবং মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুভাবে একত্রে বসবাস করার ভরসা দিতে হবে।

২) যাতে ধনপ্রাণের নিরাপত্তার অভাবে একজন মুসলমানকেও ভারত ছাড়তে না হয় , তা নিশ্চিত করতে হিন্দু আর শিখদের সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে।

৩) চলন্ত ট্রেনে মুসলমানদের উপর যে সব হামলা হচ্ছে তা এখুনি বন্ধ করতে হবে এবং যেসব হিন্দু আর শিখ এই ধরণের আক্রমণে থাকছে তাদের এসব করা থেকে নিবৃত্ত করতে হবে।

৪) নিজামুদ্দিন আওলিয়া , খাজা কুতুবউদ্দিন কাফি এবং নাসিরুদ্দিন চিরাগ দেহলভির মতন ধর্মস্থান আর দরগাহয় যে মুসলমান বাসিন্দারা থাকত , তারা অনেক দুঃখে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে , তাদের স্ব স্ব এলাকায় ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন দিতে হবে।

৫) দরগাহ কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । সরকার অবশ্যই এসব পুনরুদ্ধার এবং সংস্কার করতে পারে, কিন্তু তাতে গান্ধীজীর মন উঠবে না । কিন্তু তাঁর দৃঢ় মত হল , প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে হিন্দু আর শিখদেরই এসবের পুনরুদ্ধার আর সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

৬) সবচেয়ে বড় কথা হলো , হৃদয় পরিবর্তনের আবশ্যকতা । শর্তগুলি পূরণের চেয়েও তা বেশী গুরুত্বপূর্ণ । হিন্দু আর শিখ সম্প্রদায়ের নেতাদের এ বিষয়ে গান্ধীজীকে ভরসা দিতে হবে , যাতে তাঁকে এমন একটা বিষয়ে পুনর্বার না অনশন করতে হয় ।’

প্রায় বিশ হাজার জনগণের সভায় এই শর্তের কথা মওলানা আবুল কালাম আজাদ ব্যক্ত করেন। জনগণ এই শর্ত জীবন দিয়ে হলেও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং শর্তে সম্মতিসূচক দস্তখত দেয় । একদল হিন্দু ও শিখ নেতা খাজা কুতুবুদ্দিনের ধর্মস্থান মেরামতের কাজে রওনা হয় ডেপুটি কমিশনার রণধাওয়ার সাথে। দিল্লীতে কর্মব্রতী সমিতিগুলো এই সব শর্ত পূরনে একমত হয় । পরদিন সকাল দশটায় সবাই গান্ধীজীর ঘরে সমবেত হন। প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু এবং মন্ত্রী সভার সদস্যগণ ( স্বারাষ্ট্র মন্ত্রী সরদার প্যাটেল বাদে) , পকিস্তানের হাই-কমিশনার জাহিদ হুসেন প্রমুখ হাজির হন। দিল্লীর হিন্দু ও শিখদের রাজনৈতিক মতাবলম্বী প্রায় ২৫ জন নেতা একে একে গান্ধীজীর দেওয়া শর্ত বিশ্বস্ততার সাথে পালনের অঙ্গীকার করলেন। এরপর গান্ধীজীর ইশারায় তাঁর মন্ডলীর মেয়েপুরুষেরা ‘রামধূণ’ গাইতে শুরু করলো । তাঁর নাতনি কমলা লেবুর এক গ্লাস শরবত নিয়ে আসলো । তার ইশারায় গ্লাসটি মওলানা আবুল কালাম আজাদের হাতে দেওয়া হয় । মওলানার কাছে এই শরবত পান করে তিনি অনশন ভঙ্গ করলেন । এখানে স্মরণীয় যে পুনা থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করার কারণে তার উপরে হিন্দুদের একদল ক্ষুন্ন হয় । ভারত বিভাগের পর ব্যাপারটা চরম রূপ নেয় । হিন্দু মহাসভা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বের হিন্দুদের একাংশ বলতে শুরু করে ‘হিন্দুদের বিরুদ্ধে গান্ধীজী মুসলমানদের সাহায্য করছেন।’ মিঃ গান্ধী এঁর প্রার্থনা সভায় হিন্দু শাস্ত্র পাঠের পাশাপাশি পবিত্র ‘বাইবেল’ ও পবিত্র ‘কোর আন’ থেকেও আয়াত সমূহ পাঠ করা হতো। উগ্রবাদী হিন্দুরা এতে বাধ সাধে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লীতে তাঁর প্রার্থনা সভায় এইসব কারণে তারা হট্টগোল বাধিয়ে দেয়।তারা দাবী করে যে প্রার্থনা সভায় পবিত্র ‘বাইবেল’ এবং পবিত্র ‘কোর আন’ থেকে কোন আয়াত তেলাওয়াত করা যাবে না।‘তারা মিঃ গান্ধীকে ‘হিন্দুদের দুশমন` বলে প্রচার করতে থাকে। এইসব বক্তব্য সম্বলিত ইস্তাহার ও প্রচারপত্র বিলি করতে থাকে এতে এতদূর পর্যন্ত বলা হয় ‘গান্ধীজী তাঁর আচার আচরণ না পাল্টালে তাঁকে খুন করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।` তাঁর অনশনের ঘটনায় এইসব উগ্রবাদী হিন্দুরা আরও চটে লাল হয়েছিল। তারা সিদ্ধান্ত নেয় ‘ আর নয় এবার গান্ধীজী সম্পর্কে তারা একটা ব্যবস্থা নেবে।’ তিনি আবার প্রার্থনা সভা চালু করার কদিনের মধ্যেই তাঁর প্রতি বোমা নিক্ষেপ করা হয় । এই ঘৃণ্য হামলা ব্যর্থ হয় । বোমাতে কেউ আহত হয়নি।তাঁকে হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠিও আসতে থাকে। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কোন পদক্ষেপ তো নেনই নাই , বরং নির্বিকার থাকেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জানুয়ারী বিড়লা ভবনে প্রার্থনা সভায় হাজির হলে স্পষ্টতঃ সন্দেহভাজক এক ব্যক্তি ( নাথুরাম গডছে ) তাঁর সামনা সামনি হয়ে বলে ‘ আপনি আজ দেরীতে এসেছেন’ , মিঃ গান্ধী জবার দেন ‘হ্যাঁ’ এর পরই তিনটি গুলি তাঁর গায়ে বিদ্ধ হয় । এতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।মওলানা আজাদের মতে ‘ গান্ধীজীর মৃত্যুতে একটি যুগ শেষ হলো ।’ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ঘৃণা ও শোক সভায় জয়প্রকাশ নারয়ণ বলেন ‘ ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী , এই হত্যাকান্ডের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।’ কলকাতার ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বলেন ‘সর্দার প্যাটেল তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য গান্ধীজীর কাছে ঋণী এবং কড়া ও চতুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলে তার নামডাকও আছে । কেন তাহলে গান্ধীজীর জীবন রক্ষার কোনো চেষ্টা হল না —- প্যাটেল কিভাবে তার ব্যাখ্যা দেবেন।’ প্যাটেল নিজেকে নির্দাষ বলে দাবী করে বলেছিলেন এসব প্রচার করে কংগ্রেসের শত্রুরা সংগঠনে ভাঙন ধরাতে চাইছে । তার এই বক্তব্যে অনেক কংগ্রেস সদস্য তার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন।মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এভাবেই প্রাগুক্ত ঘটনাবলীর বর্ণনা করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘ভারত স্বাধীন হল‘ বইতে ।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ

সব খবর / ঢাকা / ২৭ মার্চ ২০১৮ / আসাদলিমন