রোগীর চিকিৎসা দুর্লভ, স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত ১২৫

করোনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতসহ সব খাতই বলতে গেলে বিপর্যস্ত৷ করোনার চিকিৎসা সহজ নয় আর সেই সঙ্গে ভেঙে পড়েছে অন্য রোগবালাইয়ের চিকিৎসাও৷ কষ্টে আছে বিভিন্ন খাতের শ্রমিক, কম আয়ের জনগণ৷

চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনার চিকিৎসার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা কাজে নিয়োজিতদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত হয়নি৷ এ বিষয়ে সঠিক কোনো গাইডলাইন নেই৷ তারা আরো বলেন, চিকিৎসকেরাই এখন করোনা হুমকির মুখে আছেন৷ তারা যদি রক্ষা না পান তাহলে চিকিৎসা চলবে কিভাবে!

করোনার চিকিৎসা কোথায় হয়?
করোনার চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ছয়টি হাসপাতালের কথা বলা হলেও বাস্তবে প্রস্তুত মাত্র দুইটি৷ বাকিগুলোতে শুধুমাত্র এখন পর্যন্ত টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আর ঢাকার বাইরে কয়েকটি হাসপাতালে টেস্টের ব্যবস্থা আছে৷

ঢাকার মুগদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে৷ কিন্তু সেখানে করোনার কোনো চিকিৎসা এখনো শুরু হয়নি৷ ওই হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘‘পুরোপুরি করোনা হাসাপাতাল করতে আরো সময় লাগবে৷ আমরা ফ্লু কর্নার করেছি৷ টেস্ট করে করোনা পজিটিভ পেলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল বা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই৷”

তার মতে, ‘‘যে হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা হবে সেখানে অন্য কোনো রোগের চিকিৎসা করা ঠিক নয়৷”

ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার বেড আছে ২২টি, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ২৬টি , শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে ৮টি, সাজিদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৫টি, মিরপুর ও উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালে আছে ৬টি আইসিইউ করোনা বেড৷ ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে কেবল ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি, খুলনার ডায়াবেটিক হাসপাতালে আছে ৫টি আইসিইউ বেড৷

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের নার্সদের খাদ্য সংকট চলছিল কয়েকদিন ধরে৷ তাদের ৯৯ জন নার্সের মধ্যে ৭০ জনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে একটি হোটেলে৷ হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলিমুজ্জামান জানান, ‘হোটেল কর্তৃপক্ষ বিল না পেয়ে খাবার নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছিল৷ এখন আমরা বিল দিয়ে দেয়ায় খাবার সংকট হচ্ছেনা৷’ ঢাকায় স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিতদের থাকার জন্য আরো কতগুলো হোটেল তালিকাভুক্ত করা হলেও তারা এখনো সেবা দেয়া শুরু করেননি৷

টেস্ট এখনো জটিল:
করোনা আক্রান্ত সন্দেহ হলে টেস্ট এখনো জটিল ও কঠিন৷ ১৪ এপ্রিল করোনা পজিটিভ হওয়া এক গণমাধ্যমকর্মী জানান, তিনি পাঁচ দিন চেষ্টার পর করোনা টেস্ট করাতে সক্ষম হয়েছেন৷ ওই পাঁচ দিন তিনি আইইডিসিআর ও বিএসএমইউতে দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন৷ এখন করোনা পজিটিভ হওয়ার পর বাসায়ই আছেন আইসোলেশনে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাকে একটি টেলিফোন মেসেজ দিয়ে আলাদা থাকতে বলেছে৷ তিনি বলেন, ‘পুলিশ যোগাযোগ করছে৷ কিন্তু আমার চিকিৎসা কোথায় হবে আমি জানি না৷’
এখন ঢাকায় নয়টি ও ঢাকার বাইরে ছয়টি করোনা টেস্ট সেন্টার আছে বলে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে৷

চিকিৎসায় নিয়োজিতদের নিরাপত্তা:
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আসলে ঢাকা ছাড়া জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে করোনার চিকিৎসা নাই৷ এটা করা সম্ভবও নয়৷’ তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিতদের পিপিইর নামে যা দেয়া হচ্ছে তা মানসম্মত নয়৷ নকলও আছে৷ এই কারণে ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে এখন ১২৫ জন করোনা পজিটিভ৷ ডাক্তার আছেন ৬৩ জন৷ আমার বিবেচনায় এখন পর্যন্ত ১০ ভাগের বেশি স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি৷ নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও বিষয়টি তুলে ধরছেন৷ এরইমধ্যে নকল পিপিই নিয়ে তদন্তও শুরু হয়েছে৷’
আর ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘এখনো করোনা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে সঠিক গাইড লাইন নাই৷ ফলে সাধারণ চিকিৎসাও বিপর্যস্ত৷’

যোগাযোগ ব্যবস্থা:
দেশে যাত্রী পরিবহণ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে৷ বাস-লঞ্চ-ট্রেন কিছুই চলছেনা৷ শুধুমাত্র জরুরি পণ্য ও সেবা পরিবহণ চালু আছে৷ বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মো. রস্তুম আলি খান জানান, ‘জরুরি পণ্য পরিবহনের অনুমতি থাকলেও বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হয়৷ এই খাতে ১২ লাখ শ্রমিক এখন কর্মহীন৷ অন্যদিকে বাস ও লঞ্চ মিলিয়ে কর্মহীন আরো প্রায় ৩০ লাখ৷’ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার এরায়েতুল্লাহ বলেন, ‘পরিবহণ খাতের এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিক এখনো কোনো সহায়তা পাননি৷’

কৃষি শ্রমিকরা বিপাকে:
এই সময়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে কৃষি শ্রমিকরা বেরো ধান কাটার জন্য দক্ষিণে যান৷ কিন্তু এবার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় তারা ঘরেই বসে আছেন৷ খাবারও নেই৷ লালমনিরহাট সরকারি কলেজের অধ্যাপক আরমান রহমান জানান, ‘এই সময়ে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় এলাকা থেকে কমপক্ষে ২৫ হাজার শ্রমিক কুমিল্লা, বগুড়া, ফেনী ও চট্টগ্রামে যান ধান কাটতে, কৃষি শ্রমিক হিসেবে৷ কিন্তু এবার তারা যেতে পারছেন না৷ তাদের ঘরে খাবারও নেই৷ আবার ওইসব এলাকায় কৃষি শ্রমিকের অভাবে ফসল তোলা কঠিন হয়ে পড়বে৷’