ছাত্র রাজনীতির আমূল সংস্কার চান বিশিষ্টজনেরা

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয়, সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন আমূল সংস্কার। শিক্ষাবিদ ও সাবেক ছাত্রনেতারা এ কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন তার ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায়, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে, বিরোধী মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করে, এর নাম ছাত্র রাজনীতি নয়। এ অপরাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পুরো ছাত্র রাজনীতিই বন্ধ করে দেওয়ার ফল আখেরে ভালো হবে না।

গৌরবময় অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তারা বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়েছে। পরে তা কলুষিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকীকরণ সমাধান নয়, কলুষমুক্ত করতে হবে ছাত্র রাজনীতিকে। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বনির্ভর করতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলের লেজুড়মুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বনির্ভর ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় ও হল সংসদগুলোর নিয়মিত নির্বাচন হতে হবে।

গত ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে শিবির সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। টানা ছয় ঘণ্টা নারকীয় নির্যাতন চলে আবরারের ওপর। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পুলিশ এলে ছাত্রলীগ নেতাদের বাধায় ফিরে যায়। আবরার হত্যার পর বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

তবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করাই সমাধান নয় বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয়, কলুষমুক্ত করতে হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও হল সংসদে নিয়মিত নির্বাচন করতে হবে। দেশে যেমন গণতন্ত্র দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়েও গণতন্ত্র আবশ্যক।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির সম্পর্ক নেই। কতগুলো দুর্বৃত্ত দলের নাম ভাঙিয়ে সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতন করে, অত্যাচার করে। এর ধারাবাহিকতায় একটি ছেলেকে মেরেই ফেলেছে। হত্যাকারীরা ছাত্রনেতা নয়, অপরাধী।

জ্ঞান ও মুক্তচিন্তার বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ রাজনীতি জরুরি বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কারখানা নয়, আশ্রমও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কথা বলবে, মতের আদানপ্রদান করবে, চিন্তার প্রসার ঘটাবে। তারা রাজনীতিসচেতন হবে। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমতের, বিরোধী মতের নূ্যনতম স্থান নেই।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। শিক্ষকদের জন্য পত্রিকায় নিবন্ধ লেখাও নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। বাংলাদেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা সমবয়সী। কিন্তু যখনই স্বৈরশাসন আসে, তখনই বিরাজনীতিকীকরণ শুরু হয়। স্বৈরশাসকের সময়ে খুন করা যাবে; কিন্তু রাজনীতি করা যাবে না!

তিনি আরও বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে বিপদ আরও বাড়বে। গণতান্ত্রিক রাজনীতি না থাকলে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে। ছাত্র রাজনীতিকে শুদ্ধ করতে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। যখন যে দল ক্ষমতায় তার ছাত্র সংগঠনের দখলে বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে- এ অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ক্ষমতাসীন নয়, বিরোধী মতও থাকবে। পরমতসহিষ্ণুতার পরিবেশ ও চর্চা থাকতে হবে। এর জন্য নিয়মিত সংসদ নির্বাচন হতে হবে। যারা ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করবে। ছাত্র রাজনীতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নেই বলেই বুয়েটে বছরের পর বছর নির্যাতন চলেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়নি, প্রতিকারও হয়নি। দুর্বৃত্তের হাতে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে গণতান্ত্রিকভাবে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম অনেকটা আক্ষেপ করে বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি তো বুয়েটসহ সব জায়গাতে বন্ধই রয়েছে। ফ্যাসিস্ট দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও বামপন্থি অন্যান্য সংগঠন এবং আদর্শবাদী সংগঠনগুলোকে কাজ করতে দেওয়া হয় না। সুতরাং যা নিষিদ্ধ আছে, তা নতুন করে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন আসে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ছাত্র রাজনীতির কারণে আবরার হত্যার ঘটনা ঘটেনি। ছাত্র রাজনীতির কারণে টর্চার সেল হয়নি। ফ্যাসিস্ট দখলদারিত্বের কারণে হয়েছে। এগুলো হতে পেরেছে ছাত্র রাজনীতি না থাকায়। এ দুঃসহ অবস্থা দূর করতে ছাত্র রাজনীতি নয়, দুর্বৃত্তায়ন এবং ফ্যাসিস্ট দখলদারিত্বের হাত থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মুক্ত করা দরকার।

তিনি প্রশ্ন করেন, ছাত্রদের কি দেশপ্রেমিক হওয়া উচিত নয়? দেশপ্রেমই তো রাজনীতি। বুয়েট রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রদের কাছ থেকে দেশপ্রেম ছিনিয়ে নিতে চায়? আর ছাত্র রাজনীতির নাম করে যে দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে; তার চেয়ে অনেক বড় দুর্বৃত্তায়ন তো জাতীয় রাজনীতিতে হচ্ছে। বুয়েটের ভিসি কী বলবেন, সে কারণে জাতীয় রাজনীতিও কি নিষিদ্ধ করা উচিত? মাথাব্যথা হলে কি মাথা কেটে ফেলতে হবে? আসলে ছাত্র রাজনীতির ওপর দু’দিক থেকে আক্রমণ হচ্ছে। একদিকে হচ্ছে ছাত্রলীগের ফ্যাসিস্ট দখলদারিত্ব, আরেকদিকে ওয়ান ইলেভেনের শক্তি সুশীল সমাজের নামধারী বিশেষ মহল। বিরাজনীতিকীকরণের ফর্মুলায় করা হচ্ছে। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পুরনো ফর্মুলা আবার প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিশিষ্ট আইনজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেছেন, ছাত্র রাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এমনকি হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির মানে অপরাধ নয়। শিক্ষার্থীদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখতে আপাতত তথাকথিত লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখাই শ্রেয়। তবে দাবি-দাওয়া আদায় ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা- ছাত্র রাজনীতি সে ধারায় ফিরে এলে আবার উন্মুক্ত করতে হবে। অপরাধ করে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার তথাকথিত যে ছাত্র রাজনীতি, তা নিষিদ্ধ থাকাই শ্রেয়।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী সমকালকে বলেন, ছাত্র রাজনীতি খারাপ নয়। এ দেশের সব প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ছাত্ররা রাজনীতিসচেতন হবে, তারা তাদের অধিকার নিয়ে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে কথা বলবে, শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলবে- এটাই হওয়ার কথা ছিল। অথচ বর্তমানে লেজুড়বৃত্তির যে ছাত্র রাজনীতি চলছে, ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ছাত্ররা ব্যবহূত হচ্ছে, এ রাজনীতির দরকার নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে যে ছাত্র রাজনীতি চলছে তা অসুস্থ। এটি রোগের উপসর্গ। রোগ চিহ্নিত করে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বুয়েটে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটি সাময়িক ব্যবস্থা। কোনো দীর্ঘমেয়াদি ফল এ থেকে আশা করা যায় না।

রাশেদা কে. চৌধুরী আরও বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। মাথা ব্যথা হলে মাথা কাটা সমাধান নয়। ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের স্বার্থে পরিচালিত হোক, তাতে নীতি ও আদর্শ থাকুক, তা-ই চাই। আর তা হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক। আদর্শ না থাকলে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মাস্তানি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ঢুকে পড়বে। দীর্ঘ ২৯ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, এতদিন স্থবিরতা থাকলে শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশা ঢুকে পড়বে। তা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যায় না। ছাত্র রাজনীতিতে সুদিন ফেরাতে নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, পরমতসহিষ্ণু, যোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা ছাত্রদের অধিকারের জন্য কাজ করবে। সূত্র: দৈনিক সমকাল।