ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও সিএন্ডএফ এজেন্ট হাসান সোহাগ

ঢাকা অফিস: ব্যবসার ছদ্মাবরণে বছরের পর বছর প্রতারণা করে আসছে ‘হাসান আহমেদ সোহাগ’ ওরফে ‘হাসান সোহাগ’ নমের এক ব্যক্তি। দেশে আমদানি বাণিজ্যের সঙ্গে নিয়োজিত ব্যবসায়িদের টার্গেট করে দিনের পর দিন প্রতারণা করে আসছেন এই হাসান সোহাগ। তার পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘কামাল এন্টারপ্রাইজ’, ‘আর এফ ট্রেড লিমিটেড’, ‘রোজা ইন্টারন্যাশনাল’, । এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতারণার কাজে ডাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে সে।

খবর নিয়ে জানা গেছে, এই হাসান সোহাগ একজন সিএন্ডএফ এজেন্ট। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য বন্দর থেকে খালাসের জন্য আমদানিকারকগণ সিএন্ডএফ এজেন্টদের উপর নির্ভরশীল। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আমদানিকারকদের জন্য এক লোভনীয় ফাঁদ তৈরি করে এই কৌশলী প্রতারক। হাসান সোহাগ দেশের নতুন আমদনিকারকদের টার্গেট করে ‘কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি’ কমিয়ে পণ্য খালাস করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এদের মধ্যে যারা হাসান সোহাগের পাতানো ফাঁদে পরে তারা হয় পুঁজি হারায় না হয় পণ্য হারায়।

অভিযোগে জানা গেছে, কাস্টমস’র বিভিন্ন অফিসারদের সাথে তার (হাসান সোহাগ) অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলেও সে দাবি করতো। কোনো কাস্টমস কমিশনার আত্মীয়, কোনো কাস্টমস অফিসার তার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে নতুন ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলতো।

জানা গেছে, একাধিক আমাদনিকারক তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন। সে আমাদানিকারকদের স্বল্প ‘কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি’তে পণ্য খালাস করে দেওয়ায় লোভ দেখায়। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আমদানিকারকগণ তাদের পণ্যের ইনভয়েস এবং অন্যান্য শিপিং ডমুকেন্ট তৈরি করে। পণ্য বন্দরে পৌঁছার পর একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে তার আসল চেহারা। একের পর এক সে আমাদানিকারকদের ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে এবং তাদের পণ্য আটকিয়ে রেখে থেকে টাকা দাবি করতে থাকে। অসহায় আমদানিকারকগণ তাদের পণ্য পাওয়ার আশায় তার দাবি পূরণ করতে থাকে। এভাবে একটা সময় পণ্য খালাস না করেই সমূদয় অর্থসহ আত্মগোপনে চলে যায় হাসান সোহাগ। এ ছাড়াও আমদানিকৃত পণ্য খালাস করে আমদানিকারকের অগোচরে বিক্রি করে টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এই প্রতারকের প্রতারণার শিকার ব্যাবসায়ীর সংখ্যা অনেক। ভুক্তভোগী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে জানা গেছে অনেক তথ্য। ‘হাসান সোহাগ’র ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়া এক ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী হলেন কামরুজ্জামান সজিব। দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানের পর দেশে ফিরে টাইলসের দোকানে চাকরির পাশাপাশি টাইলসের লট বেচা-কেনা করতেন তিনি। নিজের জমানো টাকা ছাড়াও আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করে কোন রকমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই ব্যবসায়ীর সাথে হঠাৎ করেই পরিচয় হাসান সোহাগের। সে নিজ থেকেই ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান সজিবকে কম দামে চায়না টাইলস আমদানি করে দেওয়ার কথা বলে তার থেকে আঠারো লাখ আশি হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। আমদানি করা টাইলস তো দূরের কথা বরং নিজের এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে ধারে আনা টাকার চিন্তায় পাগলপ্রায় এই ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী। অসহায় এই ব্যাবসায়ী আক্ষেপ করে বলেন, ’হাসান নিজেরে পরিচয় দিতো অমুক কাস্টমস কমিশনার, তমুক অফিসারের সাথে তার উঠাবসা। এখন আমার টাইলসও নাই, সেও নাই। তার কাছে আমি ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাওনা। আইন-আদালত করে টাকা আদায় করার মতো অবস্থাও আমার নাই। প্রতারক হাসান সোহাগ ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান সজিবকে টাকা লেনদেনর সময় গ্যারান্টি হিসেবে একটি ব্যাংক চেকও দিয়েছিলো। কিন্তু ওই চেকের বিপরীতে কোনো টাকা নেই।

তার সূক্ষ্ণ চতুরতার কাছে পরাস্ত হওয়া আরেক প্রতিষ্ঠান ‘সাবিত এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড’। এই প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, হাসান সোহাগ আমাদের প্রকল্পে টাইলস ইমপোর্ট করে সাপ্লাই দেওয়ার জন্য চুক্তিবন্ধ হয় এবং সে অনুযায়ী অগ্রিম টাকা বুঝে নেয়। সিকিওরিটি হিসেবে চেক প্রদান করে। কিন্তু সে টাইলস আজও আমাদের প্রকল্পে পৌঁছায়নি। সিকিউরিটি হিসেবে চেকগুলো যে একাউন্টের বিপরীতে প্রদান করেছিলো সে একাউন্টে কোন ব্যালেন্সই নেই। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সে আত্মগোপনে রয়েছে। তার সাথে যোগাযোগের কোন ব্যবস্থাই নেই।

অভিযোগে জানা গেছে, মানুষকে ঠকানোর জন্য হাসান সোহাগ তার বনশ্রীর ‘বি’ ব্লকের অফিস, চটট্টগ্রামের হালিশহরের ‘সাথী টাওয়ার’র অফিসের পাশাপাশি চীনে অবস্থিত আরেকটি অফিসকে ব্যবহার করে। চীনের গুয়ানজুতে অবস্থিত অফিসটি সে ব্যবহার করে চীনে ভ্রমণে যাওয়া ব্যাবসায়িদের প্রলুব্ধ করার জন্য। বেশিরভাগ সময়ই সে চীনে অবস্থান করে তার প্রতারণামূলক ব্যবসা পরিচালনা করে। একাধিক পাসপোর্টের অধিকারী এই প্রতারকের হাত থেকে তার পিতাও রক্ষা পায়নি। তার বাবার ব্যাবহৃত প্রাডো গাড়িটি গোপনে বিক্রয় করে দেয় এই প্রতারক।

তার ঠগবাজির শিকার আরেক প্রতিষ্ঠান ‘দি হার্ডরক ইন্টারকন্টিনেন্টাল কর্পোরেশন’। তার ভুল পরামর্শে আমাদানিকারক এই প্রতিষ্ঠান ইনভয়েসে পণ্যের পরিমাণ সত্যিকার পরিমাণের চাইতে কম দেখায়। পরবর্তীতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্য আটক করে জরিমানা আরোপ করে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জরিমানার টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য সিএন্ডএফ এজেন্ট হাসান সোহাগকে প্রদান করলে সে পুরো টাকাই আত্মসাৎ করে ফেলে। তারও পূর্বে উক্ত প্রতিষ্ঠান চীন এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে বেশ কিছু কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করে। এলসির মাধ্যমে আনা পণ্যসমূহ বন্দর থেকে খালাসের জন্য হাসান সোহাগকে ওয়ার্ক অর্ডার প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এই প্রতারক বন্দর থেকে পণ্যসমূহ খালাস করে আমদানিকারকের অগোচরে নিজেই বিক্রি করে দেয়। ‘দি হার্ডরক ইন্টারকন্টিনেন্টাল কর্পোরেশন’ এর বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তা মামুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রতারক হাসান সোহাগ আমাদের ভুল বুঝিয়ে করে টাইলস খালাসের জন্য আমাদের থেকে প্রায় ৯৩ লাখ টাকা গ্রহণ করে। বন্দর থেকে ৮৩ লাখ টাকার পণ্য খালাস করে নিজেই গোপনে বিক্রয় করে ফেলে। এছাড়া আরো দুটি এলসি’র মাধ্যমে আনা পণ্য খালাস না আরো প্রায় ৭৭ লাখ টাকার ক্ষতি করে। এভাবে সে আমাদের সাথে প্রায় ২ কোটি ১৩ লাখ টাকার প্রতারণা করে।’

তার বিরুদ্ধে কি ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মামুন বলেন’ ‘তার প্রতারণার সকল ডকুমেন্ট আমাদের কাছে আছে। সে উক্ত টাকা ফেরত দেবে মর্মে স্বীকারোক্তিও প্রদান করেছে। সেই সাথে সমপরিমাণ টাকার ব্যাংক চেকও দিয়েছিলো। কিন্তু সে চেক ডিসঅনার হয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।’

প্রতারণার টাকায় হাসান আহমেদ সোহাগ ওরফে হাসান সোহাগ রাজধানীর বসুন্ধরায় কিনেছে বিলাস বহুল ফ্ল্যাট। বিভিন্ন জায়গায় গড়েছে বিশাল বিত্ত সম্পত্তি। এছাড়া দেশের বাহিরেও সে নিয়মিত প্রচুর পরিমাণ অর্থ পাচার করে। তার পিতা মো: ফিরোজ মিয়াও দীর্ঘদিন থেকে সিএন্ডএফ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। প্রতারণার কাজে হাসান সোহাগকে তার দুই জন স্টাফ তৌহিদুল ইসলাম এবং ফয়সাল প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে। অবৈধ টাকার লেনদেনের মূল মাধ্যম এই দুইজন ব্যক্তি। অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

অত্যন্ত দক্ষ ও পেশাদার এই প্রতারকের টার্গেটই থাকে নিত্য-নতুন আমদানিকারকদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে তাদেরকে তার সূক্ষ প্রতারণার জালে আটকানো। এরপর তাদেরকে বিভিন্ন কৌশলে ব্ল্যাক মেইল করে হাতিয়ে নিতে থাকে অর্থ। তার ফাঁদে পা দেওয়ার ব্যাবসায়ীর তালিকায় রয়েছে জনপ্রিয় পোষাক ব্রান্ড ‘এক্সটেসি’। প্রতিষ্ঠানটির মালিক তানজিম এবং ম্যানেজার বাপ্পি এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এই প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাক মেইল করে সে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২৭ লাখ টাকা। এছাড়াও বাড্ডার উপশম প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক আবু ইউসূফ পাখি দুঃখ করে বলেন, হাসান সোহাগ তার কাছ থেকে প্রতারণা করে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। আজও এই টাকা পরিশোধের কোন চেষ্টাই সে করছে না। বারিধারায় বসবাসকারী তরুণ উদ্যোক্তা মো: সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকেও একই কায়দায় এই প্রতারক সিএন্ডএফ এজেন্ট হাতিয়ে নেয় প্রায় ৩৫ লাখ টাকা।

নিয়ম অনুযায়ী আমদানিকারকগণ তাদের পণ্য খালাসের জন্য সমস্ত শিপিং এবং ব্যাংক ডকুমেন্টের মূল কপি সিএন্ডএফ এজেন্টকে দিয়ে দিতে হয়। সিএন্ডএফ এজেন্ট তখন পণ্য খালাস করে ট্রাকে লোড করে পণ্য আমদানিকারকের কাছে পাঠিয়ে দিবে এটাই নিয়ম। যেহেতু পণ্য খালাস থেকে শুরু করে ট্রাক লোড করা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া সিএন্ডএফ এজেন্টের কাছে ন্যাস্ত তাই এই দুর্বলতার সুযোগকে পুঁজি করে হাসান সোহাগ আমদানিকারকগণকে রীতিমতো ব্ল্যাক মেইল করে চলেছে। কখনো কখনো পণ্য বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে নিজেই আত্মসাৎ করে ফেলে।

রাজধানীর পল্টন, ভাটারা ও রমনা থানায় তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চেক জালিয়াতিসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে। চলতি বছরেরর ৭ জানুয়ারি এই প্রতারকের বিরুদ্ধে রাজধানীল রামপুরা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার নম্বর – ১৭৫ (৫) ১। এছাড়া তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের কথা রয়েছে। যার নম্বর- ৫৮/১৩২।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে হাসান সোহাগের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আত্মগোপনে থাকার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ভুক্ত ভোগী ব্যক্তিগণ আশা করছেন বর্তমান সরকার যেভাবে বিভিন্ন প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তেমনি উক্ত প্রতারককে আইনের আওতায় এনে সাধারণ আমদানিকারকদের রক্ষা করবেন।

চট্টলানিউজ/এনএ