শান্তিময় বিশ্ব গড়তে জাতিসংঘ পূনর্গঠন ও আমার ভাবনা

হাসান আল বান্না: জাতিসংঘ (অপর নাম: রাষ্ট্রসঙ্ঘ) বিশ্বের জাতিসমূহের একটি সংগঠন, যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারষ্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ১৯৪৫ সালে ৫১টি রাষ্ট্র জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তীতে লুপ্ত লীগ অব নেশন্সের স্থলাভিষিক্ত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তি পরবর্তীকালে যাতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করা যায়, এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। তখনকার বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি জাতিসংঘের বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে এখনও প্রতিফলিত হচ্ছে। জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য (যাদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা আছে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও গণচীন।

অক্টোবর, ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা এখন ১৯৩। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত। সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রধান অঙ্গ সংস্থাগুলো হলো – সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশীপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। এছাড়াও রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ইত্যাদি। জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রধান নির্বাহী হলেন এর মহাসচিব। ২০১৭ সালের জানুয়ারি ১ তারিখ থেকে মহাসচিব পদে রয়েছেন পর্তুগালের নাগরিক অ্যান্টোনিও ম্যানুয়েল দে অলিভেইরা গুতারেস।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিতর্ক সভা হিসেবে বিশ্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে। জাতিসংঘ সনদের ১০নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে – সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের সনদের অন্তর্ভূক্ত যে-কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। পরবর্তীতে বিভিন্ন শাখায় সুপারিশ প্রেরণ করতে পারে।
বিশ্বশান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষা করাও সাধারণ পরিষদের কাজ। তাই যে-কোন রাষ্ট্র বা সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক শান্তি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে-কোন বিষয় সাধারণ পরিষদে প্রেরণ করা যায়। প্রেরিত বিষয়(গুলো) পরিষদ কর্তৃক পর্যালোচনা করার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রেরণ করা হয়।
আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করতে পারে সাধারণ পরিষদ। এমনকি বিভিন্ন রাষ্ট্রের আচার-আচরণ অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের প্রসার ঘটাতে পারে।
এ পরিষদ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করে। তাই যে কোন রাষ্ট্র বা সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক শান্তি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে-কোন বিষয় সাধারণ পরিষদে প্রেরণ করা যায়। উক্ত বিষয়ে সাধারণ পরিষদে পর্যালোচনা করার পর নিরাপত্তা পরিষদে প্রেরণ করে।
জাতিসংঘের অন্যান্য শাখার কার্য্যের অনুসন্ধান ও নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যান্য শাখাগুলো সাধারণ পরিষদের নিকট বার্ষিক প্রতিবেদন প্রদান করে। সাধারণ পরিষদ উক্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।
নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে যে-কোন রাষ্ট্রকে নতুন সদস্যরূপে গ্রহণ করতে পারে। পাশাপাশি পুরাতন যে-কোন সদস্য রাষ্ট্রকে সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে পারে।
পরিষদটি কিছু কিছু অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করে। জাতিসংঘের বাজেট পাস করা এর অন্যতম কাজ। এছাড়াও, সংস্থার বাজেট পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অনুমোদন করে। পাশাপাশি সদস্যভূক্ত রাষ্ট্রসমূহের বার্ষিক চাঁদার পরিমাণ স্থির করে।
নির্বাচন সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সম্পাদন করাও প্রধান কার্যসমূহের একটি। জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জন্য ১০জন অস্থায়ী সদস্য, আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সদস্য এবং অছি পরিষদের কতিপয় সদস্য নির্বাচন করা এর অন্যতম দায়িত্ব।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার লক্ষ্যে সাধারণ পরিষদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যাতে ছিন্ন হলে সংস্থাটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করে।

এবার আসা যাক, উপরোক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যর আলোকে জাতিসংঘ কতটা সফল ও প্রাসঙ্গিক? জাতিসংঘ তার ৭১ বছরের ইতিহাসে বারবার ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে; শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার যে দায়িত্ব সে নিজের ওপর আরোপ করেছে, তা পালনে অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। প্রায় অর্ধশতক আগে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশ জাতিসংঘের এই ব্যর্থতার শিকার হয়। যে নয় মাস ধরে বাংলাদেশ পাকিস্তানের যুদ্ধ চলে সে সময় জাতিসংঘের সব কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল কীভাবে ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, যদিও দেশে ফিরে এলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো যোগ্যতাই জাতিসংঘের ছিল না। অবশেষে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বড় কর্তারা ঘুম ভেঙে জেগে উঠে ভাবলেন, এবার তো একটা কিছু করা দরকার, আর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারত ও বাংলাদেশ নিজেরাই এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। তারও পাঁচ দিন পর নিরাপত্তা পরিষদ স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। তত দিনে লড়াই শেষ। নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও যে হাসির রোল উঠেছিল, তা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশের অধ্যায় শেষ হতে না হতেই ইতিহাস সেই একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে কম্বোডিয়ায়। তার আরও পরে বলকানে ও রুয়ান্ডায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার মুখে জাতিসংঘ ক্রমশই মনোযোগ দিয়েছে আশু ত্রাণসাহায্য প্রদানের প্রতি। সে কাজটিও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার বদলে ‘রিলিফ’ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জাতিসংঘ কার্যত একধরনের আন্তর্জাতিক রেডক্রসে পরিণত হয়েছে। বস্তুত, ত্রাণের কাজটি যদি রেডক্রসের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাদের হাতে পর্যাপ্ত সম্পদ দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে জাতিসংঘের তুলনায় তারা অনেক ভালো কাজ করতে সক্ষম হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, জাতিসংঘের মতো ‘রাজনৈতিক তারকা’দের মর্জি-মেজাজ নিয়ে রেডক্রসকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয় না।

জাতিসংঘে দ্বিতীয় মহাসচিব ড্যাগ হ্যামারশোল্ড বলেছিলেন, জাতিসংঘ মানবসভ্যতাকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। বরং নরক থেকে বাঁচানোর জন্য এ সংস্থার জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘের জন্ম হয়। সারাবিশ্বে শান্তি স্থাপন ও স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই সংস্থাটির জন্ম। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ সালে সংস্থাটির জন্ম তা কী পূরণ হয়েছে?

অনেকেই মনে করেন শক্তিশালী রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘকে ব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন প্রত্যেকেই পরমাণু শক্তিধর। তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সবসময় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যুতে ভেটো দিয়ে আসছে। কোনো সংকট নিরসনে সুস্পষ্ট সমাধানে আসার আগ্রহ দেখা যায় না তাদের মধ্যে। এ যেন একটি বিভক্ত বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব।

যদিও সারাবিশ্বে জাতিসংঘ শিশু শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, বিভিন্ন মারাত্মক রোগ প্রতিরোধে এবং শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে সংস্থাটি প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সম্মুখীন হয়েছে সমালোচনার। শান্তি রক্ষার জন্য যে সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা সংঘাত ঠেকাতে এবং বিশ্বকে এক করতে ব্যর্থ হয়েছে। মাত্র ৭২ বছরে সংস্থাটির অর্জন খুবই সামান্য।

সংঘাতপ্রবণ দেশে শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের মানবিক হস্তক্ষেপ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। দারফুর যুদ্ধে জাতিসংঘের বাহিনী গণহত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল। ২০০৩ সালের এই যুদ্ধে তিন লাখ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে সুদানের সরকার। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জন কেলি সিরিয়ায় সংস্থাটির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমালোচনা করেন। সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষদেরকে উদ্ধার করেছিল সংস্থাটি। যুদ্ধবিধ্বস্ত নাগরিকদের জন্য ত্রাণও পাঠানো হয় সংস্থাটির তরফ থেকে। কিন্তু যুদ্ধ থামানোর জন্য বেশ কিছু আলোচনা সভার আয়োজন করা ছাড়া আর কিছু করেনি জাতিসংঘ। সংস্থাটির শান্তি রক্ষা বাহিনীর কোনো দলও সেখানে পাঠায়নি তারা।

উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি ঠেকাতে জাতিসংঘ বিভিন্ন অবরোধ আরোপ করছে দেশটির ওপর। কিন্তু এতে কোনো লাভ না হয়ে হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিয়েছে।

২০০২ সালে আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তাকারী দল যায়। দেশটিতে তালেবান সরকার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে দেশটিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যে ত্রাণ দিতে, পুনরায় উঠে দাঁড়াতে জাতিসংঘ হাত বাড়িয়ে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল দেশটিতে স্থিতিশীলতা আনা। কিন্তু ২০০৭-২০০৮ সালে তালেবানরা ফের জেগে ওঠে। তালেবান বিদ্রোহীদের ঠেকাতে মার্কিনীরা বোমাবর্ষণ করে। অন্যদিকে, তালেবানরাও সেদেশের সাধারণ জনগণের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। জাতিসংঘ সেখানে কার্যকরী কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারেনি।

ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘ কিছুই করতে পারেনি। আরব-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে ২০১০ সাল পর্যন্ত সংস্থা মোট ৭৯টি মীমাংসা প্রস্তাব আনলেও তা ব্যর্থ হয়। গাজা ও পশ্চিম তীরে শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষদের খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, জাতিসংঘের এই শরণার্থী ক্যাম্পে থাকা শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মিয়ানমারের চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ সেদেশে তদন্ত দল পাঠানোর চেষ্টা করেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু দেশটির সামরিক সরকার জাতিসংঘকে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়নি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া এক হয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সমর্থন করছে। ফলে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না সংস্থাটি। অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যা।

নিকটতম অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিশ্বের অধিকাংশ নেতারা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। সেখানে বর্তমান মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বক্তব্যে জানান, বিশ্ব এখন টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তা একত্র করে করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু মহাসচিবের এই আহ্বান কি সত্যিই শুনবেন বিশ্বনেতারা? ইতিহাস বলে, অতীতে শক্তিধর রাষ্ট্র এধরণের আহ্বনে সাড়া দেন নি। অতএব ভবিষ্যতেও যে দিবেন না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। সমস্যায় জর্জরিত দেশগুলো সমাধান চাইতে আসে আর শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখায়। মানবিক দিক থেকে অনেকেই বিবেচনা করে না। তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন পরিণত হয় শুধুই মিলনমেলায়। আর বিশ্ব মানবতা সেখানে কেঁদে ফেরে।

এমতাবস্থায় বিশ্ব শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ এই আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সংস্কার ও পূনর্গঠনে আমার প্রস্তাবনাঃ

ক. সদর দপ্তর
১. পৃথিবীর কোন এক দ্বীপে নিজস্ব স্বাধীন ভূখন্ডে জাতিসংঘের সদর দপ্তর অবস্থিত হবে।
২. সদর দপ্তর ভূখন্ড সম্পূর্ণ স্বাধীন যার নিরাপত্তা সদস্য রাষ্ট্রের সকল দেশের সম্মিলিত বাহিনী দিবে।

খ. মহাসচিব নির্বাচন
১. মহাসচিব নির্বাচন হবে তিন বছর পর পর।
২. সদস্য রাষ্ট্রের যে কোন দেশই মহাসচিব প্রার্থী দিতে পারবে।
৩. সাধারণ অধিবেশনে সরাসরি ও স্বচ্ছ ভোটে মহাসচিব নির্বাচিত হবে।
৪. অন্যান কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে সদস্য রাষ্ট্র ও সংস্থা সমূহের কোটাভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হবে। তবে খোলা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও যথা পরীক্ষা/প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান করা হবে।

গ. নিরাপত্তা পরিষদ বাতিল
১. আমেরিকা, ফ্রান্স, বৃটেন, চীন, রাশিয়া এর পাঁচ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যপদ বাতিল করতে হবে।
২. নিরাপত্তা পরিষদের নাম হবে নির্বাহী পরিষদ যা প্রত্যেক মহাদেশ কর্তৃক মনোনীত রাষ্ট্র সমূহের ৬ টি রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর মৌলিক পাঁচটি ধর্ম ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদী, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের একটি করে প্রতিনিধি রাষ্ট্র থাকবে। মোট ১১ রাষ্ট্রের নির্বাহী পরিষদ গঠিত হবে।
৩. অথবা বর্তমান পাঁচ নিরাপত্তা সদস্য রাষ্ট্রের সাথে অবশিষ্ট মহাদেশের প্রতিনিধি রাষ্ট্র এবং মৌলিক ধর্ম সমূহের প্রতিনিধি রাষ্ট্র সহ নির্বাহী রাষ্ট্র পরিষদ গঠিত হতে পারে।

ঘ. সকল জাতির অংশগ্রহণ
১. সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও পৃথিবীর সকল জাতি ও ধর্মের প্রতিনিধি থাকবে। যেমন – রোহিঙ্গা, বাঙ্গালী, হিন্দু, বৌদ্ধ, তামিল, আফ্রিকান, তিব্বত সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী।
২. বিভিন্ন জাতি ধর্মের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সদস্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানদের মতই যোগদান করবে।
ঙ. মধ্যপ্রাচ্যকে আলাদা মহাদেশ ঘোষণা করা হবে।
নামঃ ইসলামী মহাদেশ

চ. আগ্রাসন ও যুদ্ধ বাতিল
১. কোন পরাশক্তি রাষ্ট্র দূর্বলতম রাষ্ট্রের উপর আগ্রাসন ও যুদ্ধ করলে সে দেশের সদস্যপদ বাতিল করা হবে।
২. আগ্রাসন ও যুদ্ধের জন্য দায়ী শাসকদের সারা পৃথিবীর সকল ইমিগ্রেশনে নিষিদ্ধ করা হবে।
৩. আগ্রাসন ও যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী কোন বেক্তিকে পৃথিবীর কোন দেশ আশ্রয় দিলে সে দেশের প্রতি অবরোধ আরোপ করবে জাতিসংঘ।

ছ. পরমানু অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করা
১. সকল পরমানু অস্ত্র ও মানবতা বিদ্ধংসী বোমা নিষ্ক্রিয় করা হবে।
২. কোন দেশ রাজি না হলে জাতিসংঘের সদস্য পদ বাতিল ও সবধরনের অবরোধ জারি করা হবে।

জ. আন্তর্জাতিক মূদ্রা ও ব্যাংক গঠন
১. আমেরিকান ডলার খনি উৎপাদনের বিপরীতে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র সমূহের লেনদেনের জন্য জাতিসংঘের নিজস্ব মূদ্রা তৈরী করা হবে।
২. আন্তর্জাতিক ব্যাংক গঠন করা হবে। যার নাম United Bank, এই ব্যাংকের শাখা প্রতিটা সদস্য ও জাতিগোষ্ঠীর দেশেই থাকবে।
৩. আন্তর্জাতিক মূদ্রা ব্যবস্থা ও ব্যাংকের আয় পৃথিবীর মানবসভ্যতার উন্নয়নে ব্যায় করা হবে।
৪. আয় ব্যায়ের সকল হিসাব ও খাত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পেশ করার পাশাপাশি পৃথিবীর সকল গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে।

ঝ. আন্তর্জাতিক সকল সংস্থা প্রতিনিধিত্ব করবে।
১. ওআইসি, কমনওয়েলথ, আসিয়ান, বিমসটেক, সার্ক, ওপেক, আরব লীগ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ সকল সংস্থার প্রতিনিধি / মহাসচিব জাতিসংঘের সদস্য হবে। সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়ে তারা তাদের কার্যক্রম তুলে ধরে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রনয়নে অংশ নিবে।

ঞ. বিবিধ
বিশ্ব মজলুম মানবতা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন রোধ, বিশ্ব ব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, ধর্মীয় স্বাধীনতার অবাধ অধিকার, নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের অধিকার, গণমাধ্যম স্বাধীনতা, মৌলিক ও মানবিক অধিকার, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক, নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সমকামীতা ও পরকীয়া সহ সকল বিকৃত যৌনাচার বৃত্তি নিষিদ্ধ করা, সকল সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রতার মূলোৎপাটন, শিক্ষা ও সুস্থ সাংস্কৃতির প্রসার, আইনের শাষন প্রতিষ্ঠা সহ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘকে একটি কার্যকর সংস্থায় পরিণত করা হবে।

লেখক ও প্রস্তাবক: কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক