হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা

কমরেড মাহমুদ : পাঞ্জাবী গায়ে মাথা কাত করে ঘাড়ের সাথে মোবাইল চেপে ধরে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে আসে সুমন, হাতে তখনও পাজামার ফিতা বাধছে। সে সকাল থেকেই খুব ব্যাস্ত। দুবার ফোন এসেছে এরই মধ্যে! কোন রকম গোসল শেষ করে সকালে নাস্তা না করেই এভাবে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে যায়। দ্রুত তাকে টিএসসিতে যেতে হবে। বন্ধুরা সব অপেক্ষা করছে তার জন্য। আজই সে শিমুর কাছে প্রকাশ করবে মনের না বলা কথা। বছরের এই একটি দিন আসে মনের কথা প্রকাশের। ভালোবাসা প্রকাশের দিন এটা। আজ একবার হলেও বলবে, খুব খুব ভালোবাসি তোমাকে….

রাস্তায় এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে রিক্সা খুঁজতে থাকে। খালি রিক্সা না দেখে সামনে হাটা দেয়। সেই হাটাটাও দৌড়ানোর মত লাগে। আজ খালি রিক্সা পাওয়া কঠিন হবে সে জানে। সেজেগুজে ছেলে মেয়েরা রিক্সার হুট তুলে হারিয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। সুমনেরও খুব ইচ্ছা হয় এভাবে শিমুকে নিয়ে এদিক সেদিক হারিয়ে যেতে। বছরে এই একটি দিনই আছে প্রিয়জনকে নিয়ে হারিয়ে যেতে হয়!

এই রিক্সা! ডাক দেয় খালি একটা রিক্সা দেখতে পেয়ে।

টিএসসিতে চলেন চাচা.. বলেই লাফ দিয়ে রিক্সায় চেপে বসে।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলুন! সুমন রিক্সায় উঠার পরেও রিক্সা চালক দাঁড়িয়ে থাকলে সে বলে ওঠে।

ও, বাবা আমনে একা! আমি ভাবছি আর একজন আসবে তাই বইসা আছি।

বুঝতে পেরে হা হা হা করে হেসে দেয় সুমন। না চাচা, আমি এখনো একাই। আপনি চলেন।

চলতে শুরু করে রিক্সা। তখনই সুমন বুঝতে পারে সে বিশাল ভুল করে ফেলেছে! এই বুড়া চাচার রিক্সায় গেলে কখন টিএসসি উপস্থিত হবে কোন ঠিক নেই। চাচা একটু দ্রুত চলেন, বলে উঠলো সুমন।

বুড়া চাচা সিট থেকে উঠে রডের উপর থেকে প্যাডেলে দাঁড়িয়ে রিক্সা টানাতে থাকে। মাজা বেকে যাচ্ছে তার এক দিকে। ঘামে পিঠ ভিজে উঠেছে পিছন। ক্যা ক্যা শব্দ করে ওঠে রিক্সা কিন্তু তারপরেও দ্রুত চলেনা। এই বয়সে রিক্সা নিয়ে বের হয়েছে কেন ভাবতেই অবাক হয়ে যায় সুমন। বিরক্তি নিয়েই বলে ফেলে, টানতে পারেননা ঠিকমত, রিক্সা নিয়ে বের হয়েছেন কেন চাচা? আপনার কোন ছেলে নেই?

পিছন ফিরে একবার তাকায় সুমনের দিকে। একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, সবই ছিল বাবা! আমার কামাই ছুত ছেলে, ছেলে বউ, একমাত্র নাতনী আর আমরা দুই বুড়াবুড়ি। আলহামদুলিল্লাহ্‌ অনেক সুখেই দিন কাটতেছিল। পাংখ্যার চড়ের তিনতলা বস্তিতে থাকতাম। দুদিন আগে ভুমিকম্পে বস্তির যে ঘর গুলো ভাইঙা গেলো তার দুইটা ঘরে আমরা থাকতাম। সবাই তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে আসতে পারলেও একটা পিলার ভাইঙা আমার ছেলের উপরে এসে পড়লো। আমার ছেলের কোলে তখন নাতনীটা ছিল। নিজের মেয়েকে বুকের তলে রেখে সে পিঠ দিয়ে ঠেকায় রাখে পিলার। লোকজন এসে যখন উদ্ধার করে দেখি নাতনীটা আমার ছেলের বুকের নিচে কানতাছে আর ছেলের মাথার ভিতর একটা টিন ঢুকে আছে। পিঠের উপর দুইটা পিলার চাপা খাইলে সে বের হইতে পারে নাই। নাতনীর একটা পা ভেঙে গেলেও জানে বাইচ্চা গেছে কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচাইতে পারি নাই। নাতনীটা এখনো ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতেছে। আমার ছেলে তার মেয়েটাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো। তাইতো জীবন দিয়ে তার মেয়েকে বাচানোর চেষ্টা করছে। এখন সংসার চালাইতে ও নাতনীটার চিকিৎসা করাইতে আমাকে রিক্সা নিয়ে বাইর হইতে হইছে বাবা!

বুড়া চাচা গামচা দিয়ে চোখ মুছে রিক্সা চালানোয় মনোযোগ দেয়। কিছুক্ষন দুজনেই নিরব হয়ে থাকে। সুমনের সামনে ভালোবাসার একটি স্বরুপ উম্মোচন হয়ে যায়। সে অনুভব করে ভালোবাসা প্রকাশের কোন নির্দিষ্ট দিনক্ষন নেই। সন্তানের প্রতি পিতা মাতার ভালোবাসা, পিতা মাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, স্বামী স্ত্রী, ভাই বোন বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জনের জন্য মনের গভীরে যে ভালোবাসা থাকে সেটা সময় নির্ভর না। এটা সর্বক্ষণ চলমান একটি অনুভুতি…

চাচা রিক্সাটা ঘুরিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে চলুন। বললো সুমন।

চাচা অবাক হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। কেন বাবা, টিএসসিতে যাইবেন না?

নাহ, আজ আর ওদিকে যাবোনা। আজ আপনার নাতনীকে দেখতে যাবো। আপনার নাতনীর চিকিৎসার ভার সব নিতে না পারি, কিন্তু যন্ত্রনায় কাতর একটি শিশুর চোখের পানিটা নিজ হাতে মুছে দিতে পারবো। চলুন চাচা আপনার নাতনীর কাছে নিয়ে চলুন। সে একজন বাবার, একজন পুরুষের, একজন মানুষের হৃদয় নিঙ্ড়ানো সবটুকু ভালোবাসা ধারন করা জলন্ত প্রতীক। আমি সেই ভালোবাসাটাকে একটু স্পর্শ করে ভালোবাসা জিনিসটাকে অনুভব করতে চাই…

সব খবর/ পঞ্চগড়/ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/ লিটন