প্রয়োজনের অর্ধেক যন্ত্রপাতিও নেই। অভাব রয়েছে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের। প্রকল্প পাসের ক্ষেত্রেও আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিশ্বসেরা বন্দরের তালিকায় ক্রমশ শক্ত অবস্থান তৈরি করছে চট্টগ্রাম বন্দর। ‘লয়েডস লিস্ট’ প্রকাশিত বিশ্বের ‘ওয়ান হান্ড্রেড পোর্টস ২০১৯’-এর তালিকায় এবার ছয় ধাপ এগিয়ে ৬৪তম স্থান দখল করেছে দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দর। তালিকায় এবারই সবচেয়ে ভালো করেছে ১৩২ বছরের পুরনো বন্দরটি।
সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ে কাজ করা লয়েডস লিস্টের ওয়েবসাইটে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। গত বছর এ তালিকায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের অবস্থান ছিল ৭০তম। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সম্মানজনক এ তালিকায় প্রবেশ করে চট্টগ্রাম বন্দর। সে বার অবস্থান ছিল ৯৫তম। এ হিসাবে গত এক দশকে ৩১ ধাপ এগিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। অগ্রগতির এ ধারা ধরে রাখতে নতুন পাঁচটি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এসব প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করা গেলে লয়েডস লিস্টের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর সেরা পঞ্চাশে থাকবে বলে মনে করেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।
দেশে তিনটি সমুদ্রবন্দর থাকলেও আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ ভাগ এখনও নিয়ন্ত্রণ করছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০১৮ সালে এ বন্দরে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার ওঠা-নামা হয়েছে ২৯ লাখ তিন হাজার। কার্গো পণ্য ওঠা-নামা হয়েছে ৯ কোটি ৬৩ লাখ টন। ক্রমবর্ধমান নৌ-বাণিজ্যও সামাল দিচ্ছে এ বন্দর। গত বছর তারা সামাল দিয়েছে তিন হাজার ৭৪৭টি জাহাজ। প্রতি বছর গড়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল রেখেছে এ বন্দর। অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকায় বিশ্বসেরা বন্দরের তালিকায় ক্রমশ ওপরের দিকে উঠছে চট্টগ্রাম বন্দর। ৩০ জুলাই প্রকাশিত লয়েডসের সর্বশেষ এই তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে চীনের সাংহাই বন্দর। ২০১৮ সালে চার কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার ২০০ টিইইউএস (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ) কনটেইনার সামাল দেয় তারা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, ‘১৩২ বছর ধরে দেশের অর্থনীতি বিনির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় সফল ছিল বলেই আজ দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ বলা হয় চট্টগ্রাম বন্দরকে। কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে না পারলেও সীমিত সম্পদে সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছি আমরা। তাই বিশ্বসেরা বন্দরের তালিকায় ক্রমশ এগোচ্ছি আমরা। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি জেটি এবং যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়ানো গেলে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে সেরা পঞ্চাশে আসতে পারবে চট্টগ্রাম বন্দর।’
বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, বছরে বাড়তি চার লাখ টিইইউএস কনটেইনার পরিচালনায় এরই মধ্যে শুরু হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ। এক হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে এ টার্মিনালের ২০ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে প্রায়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের জুনে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এখানে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ১০ মিটার গভীরতার আরও তিনটি কনটেইনার জাহাজ ও ২২০ মিটার দৈর্ঘের ডলফিন জেটিতে তেলবাহী জাহাজ নোঙর করতে পারবে। ১৬ একর ব্যাকআপ ইয়ার্ডে বাড়তি সাড়ে চার হাজার কনটেইনারও রাখা যাবে। এ প্রকল্পের অধীনে এক লাখ ১২ হাজার বর্গমিটারের অভ্যন্তরীণ ইয়ার্ড এবং সড়কও নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে। জমি নিয়ে জটিলতা কেটে যাওয়ায় এখন দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে এ প্রকল্প। বে-টার্মিনালে একটি এক হাজার ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, এক হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল ও ৮৩০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল-২ তৈরি করা হবে।
বে-টার্মিনাল হলেই চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতা তিন গুণ বেড়ে যাবে। এখন সাড়ে ৯ মিটারের বড় কোনো জাহাজ বন্দরে নোঙর করার সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু বে-টার্মিনাল হলে ১২ থেকে ১৪ মিটার জাহাজও সরাসরি জেটিতে নোঙর করতে পারবে। এখন নাব্য সংকটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ প্রবেশ করাতে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তবে বে-টার্মিনালে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই নোঙর করানো যাবে জাহাজ।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় লালদিয়া নামে আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এক হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের নতুন আরও পাঁচটি জেটি বাড়বে। পতেঙ্গায় ১৪ ও ১৫ নম্বর খালের মধ্যবর্তী অংশে এ টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এখানে কর্ণফুলী নদীর গভীরতা বেশি। তাই এ টার্মিনালে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজও অনায়াসে নোঙর করতে পারবে। ২০২১ সালের মধ্যে এ টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল নামে নতুন আরেকটি প্রকল্প চূড়ান্ত করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রায় এক হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পও বাস্তবায়িত হবে পতেঙ্গা এলাকায়। মিরসরাইয়ে গড়ে ওঠা দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পনগরকে সহায়তা দিতে সীতাকুণ্ড এলাকায় নতুন আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সূত্র: সমকাল।