
বাস-অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা বেশ কয়েক বছর ধরে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। শুধু দূষিত আবহাওয়ার কারণে নয়, জীবনযাত্রার মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণেও স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য ঢাকা বাস-অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
করোনা-পরবর্তী সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি শহরে বসবাস আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ শহর ছেড়ে তুলনামূলক কম খরচের স্থান গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।
সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২১’ (এসভিএস) প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে দেখা যায়, ২০২০-এর তুলনায় ২০২১-এ গ্রামে স্থায়ী বসবাসের পরিমাণ বা হার বেড়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১-এ প্রতি হাজারে ১২২ দশমিক ৯ জন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে বাস শুরু করেছেন।২০২০ সালেও এর পরিমাণ ছিল ১১০ দশমিক ৬ জন। গ্রামে ফিরে যাওয়ার হার আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২০ ও ’২১ এ দুই বছর ছিল করোনা মহামারীর বছর। এ সময় বিভিন্ন জটিলতায় মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত বিবিএসের আরেক খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, গ্রামের একটি পরিবারের গড় ব্যয় ২৬ হাজার ৮৪২ টাকা, শহরের একটি পরিবারকে ব্যয় করতে হয় ৪১ হাজার ৪২৪ টাকা। অর্থাৎ চারজনের একটি পরিবারের গ্রামের চেয়ে শহরে খরচ ৫৪ শতাংশ বেশি।
ভোগ্যপণ্য ব্যয়ের ক্ষেত্রেও গ্রামের মানুষের সাশ্রয় শহরের তুলনায় অনেক বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত একটি পরিবারের ভোগ্যপণ্যে গড় ব্যয় ছিল ৩০ হাজার ৬০৩ টাকা। এ ক্ষেত্রে গ্রামের পরিবারের ব্যয় ২৬ হাজার ২০৭ টাকা, শহরে ওই পরিবারের একই খাতে ব্যয় ছিল ৩৯ হাজার ৯৭১ টাকা।
স্যাম্পল ভাইটাল জরিপে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, পল্লী থেকে পল্লীতে স্থানান্তরিত হয়েছে প্রতি হাজারে ৩১ দশমিক ৯ জন অর্থাৎ এক গ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে গেছে হাজারে ৩১ দশমিক ৯ জন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৩২ দশমিক ৭ জন।
শহর থেকে গ্রামে স্থায়ীভাবে চলে গেছে প্রতি হাজারে ৮ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৪ দশমিক ৭ জন। শহর থেকে গ্রামে মানুষের চলে যাওয়া বেড়েছে। শহরের মধ্যে স্থানান্তরের হার ছিল ১২৫ দশমিক ৯ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ১০৯ দশমিক ১ জন।
তবে পল্লী তথা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার প্রবণতা কিছুটা কমেছে। জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে গ্রাম ছেড়ে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে ৩০ দশমিক ৮ জন, ২০২০ সালে যা ছিল ৩১ দশমিক ৩ জন। শহর থেকে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে ৯৫ দশমিক ১ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৭ দশমিক ৮ জন। বহির্গমন হার গড়ে প্রতি হাজারে ছিল ৫৫ দশমিক ৯ জন, যা ২০২০ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৩ জন।
গ্রামে মানুষের চলে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ দেখা যায় বিবিএসের সম্প্রতি প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপে। এতে দেখা যায়, শহর এলাকার চেয়ে গ্রামে চলে যাওয়ার এ হার আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
২০১০ সালের জরিপে গ্রাম এলাকার মানুষ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার হার মাত্র ৫.০৫ শতাংশ, ২০২২ সালে তা দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশে। ২০১০ সালে শহরের মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার হার ছিল ১৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০২২ সালে তা ছিল ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে তেমন বড় পরিবর্তন ঘটেনি। ২০১০ সালে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছিল। মূল পরিবর্তনটা ঘটেছে ২০১৬ সালের পর থেকে।
জরিপ বলছে, ২১ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার আগের ১২ মাসে ক্ষুদ্রঋণ বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রেখেছে। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ১৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, ২০১০ সালে তা ছিল ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ।
প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরেও অপ্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমার হার বেড়েছে। বর্তমানে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ পরিবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অর্থ জমা রাখে। এ ক্ষেত্রেও গ্রামের মানুষের প্রভাব বেশি। গ্রামে ৭.০৮ শতাংশ মানুষ এ খাতে অর্থ জমা রাখে। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০১০ সালে তা ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
পরিবারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জরিপ-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্যাপ এবং নলকূপের খাবার পানি ব্যবহার করে শতকরা ৯৭ শতাংশ মানুষ, যা ২০২০ সালে ছিল ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ। উন্নত উৎস থেকে খাবার পানি ব্যবহার করে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ।
নিরাপদ খাবার পানি ব্যবহার করে ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে শতকরা ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ, যা ২০২০ সালে ছিল ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ। সোলার পাওয়ার ব্যবহার করে ২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ, যা ২০২০ সালে ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ। স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করে শতকরা ৮৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ, যা ২০২০ সালে ছিল ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ।
উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করে ১ শতাংশ মানুষ, যা ২০২০ সালে ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। পল্লী অঞ্চলের চেয়ে শহরে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি।
পাঁচ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৩৯ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৪৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। দেশের সাত বছর থেকে তার বেশি বয়সী মানুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ। পুরুষের শতকরা হার ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ। মহিলা ৭৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ।
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিমাণ বাড়তে থাকা বা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সহজলভ্যতার কারণে গ্রামই এখন প্রথম পছন্দ হয়ে উঠছে সবার।