অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যেই ঐক্য প্রক্রিয়া

ড. কামাল হোসেন। বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচনা কমিটির প্রধান ছিলেন। এখন গণফোরামের সভাপতি ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক।

সম্প্রতি সমমনাদের নিয়ে বৈঠক করে অভিন্ন ৭ দফা দাবির ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় তার এই আহ্বান নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন এই রাজনীতিক ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি, জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া, সমালোচনার জবাব ছাড়াও আইনের শাসন, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন তিনি।

জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে আপনারা বসেছিলেন। কী সিদ্ধান্ত হলো?

বৈঠক থেকে ন্যূনতম অভিন্ন দাবির ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরা যে ৭ দফা দিয়েছি, এটাকে কেন্দ্র করেই আলোচনা হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থা, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’— সংবিধানের এ ঘোষণার কার্যকর বাস্তবায়ন কিভাবে করা যায়; গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা, জাতীয় স্বার্থে জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের উদ্যোগ বিষয়ে আলাপ হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীরাও সাত দফা দিয়েছেন।

ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ৭ দফা কি আপনাদের থেকে আলাদা কিছু?

আলাদা ঠিক বলা যাবে না, কাছাকাছি আছে। তাদেরটার বিষয়ে তারা কাজ করবেন, আমরা আমাদেরটা নিয়ে। যেহেতু এর মধ্যে অনেকগুলো মোটামুটি কমন, সভা-সমাবেশে আমরা আমাদের কথা বলব, তারা তাদের কথা বলবেন।

তাহলে দফাগুলো একসঙ্গে হলো না কেন?

না, আমরাতো এক হতে চাই না। আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।

চলমান পরিস্থিতিকে আপনারা কেন সংকট হিসেবে তুলে ধরছেন?

আপনি যদি মনে করেন, দেশে কোনো সংকট নেই, এর চেয়ে সুন্দর সময় আপনি জীবনে দেখেননি, সেটি আপনি বলতে পারেন। কিন্তু, আমরা সংকট কেন বলছি, সেটি যদি আপনারা সাংবাদিকরা উপলব্ধি করতে না পারেন, তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। আপনি নিজেই বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন, সংকট বুঝতে পারবেন। না আদর্শ সমাজ, না আদর্শ রাষ্ট্র বলা যায়! আমি সংকট বলি, কারণ এটা আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা না। সন্ত্রাস, মারামারি-কাটাকাটি, মানুষ অপহরণ হচ্ছে— এসব কোনো আদর্শ সমাজের সংজ্ঞায় পড়ে না।

ঐক্যবদ্ধভাবে আপনারা যে কর্মসূচিগুলো পালন করতে যাচ্ছেন, কর্মসূচিগুলোর ধরন কী হবে?

জনসভা, গণসংযোগ, সমাবেশ করা হবে। আমাদের বক্তব্য লিখিতভাবে পত্রপত্রিকায় তুলে ধরা হবে। এই যে, আপনাকে ইন্টারভিউ দিচ্ছি, এটাও আমাদের কাজের একটা দিক। আমরা কি চাচ্ছি, সেটি মানুষকে বোঝানো। মানুষের মনকে জয় করার মধ্যদিয়ে এ কথাগুলো ব্যাখ্যা করা। মানুষ যদি একবার বিষয়টা বুঝতে পারেন, ধরতে পারে, সংঘবদ্ধ হন, এর মধ্যেই একটি শক্তি সৃষ্টি হয়, যেটি দিয়ে আমরা পরিবর্তন এনেছি, বারবার এনেছি। জনমত গঠন করার মধ্যদিয়েই তো আমরা যেটা আশা করি, একটা উন্নত পরিবেশ পাওয়া যাবে। সেই উন্নত পরিবেশের মধ্যদিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পাব, নির্বাচনের মধ্যদিয়ে উপযুক্ত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু রাজনৈতিক বলয় তৈরি হবে, আমরা সেটাই চাই।

জাতীয় ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নিয়ে অতীতেও আপনারা খুব একটা এগোতে পারেননি। এর কারণ কি?

না, না, কেন এগোতে পারিনি? ২০০৮ সাল কী করে হলো? ২০০৫ সালে আমরা শুরু করার পর ২০০৮ সালে (আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনকে ইঙ্গিত) যে পরিবর্তন আসল, আমি মনে করি ওটা আমাদের সফলতা। তো একটা বিষয়, ঐক্য যখন গড়ে উঠে এবং এর মধ্যদিয়ে যখন পরিবর্তন আসে, তারপর ঐক্যকে সুসংহত না করার ফলে কিন্তু এটা হাতছাড়া হয়ে যায়। এটা থেকে আমাদের কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার যে, ঐক্য শুধু গড়ে তোলা না, এটাকে সুসংহত করা খুবই প্রয়োজন।

ঐক্য প্রত্যাশীদের নিজেদের অনৈক্যের কারণেই কি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না?

আমাদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য না। গণফোরামের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। হ্যাঁ, এটা বলতে পারেন, এটা সুসংহত হয় না কেন? কারও কারও সংকীর্ণ স্বার্থের কারণেই এটা হতে পারে না।

বিএনপির শরিক জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করবেন আপনারা?

ভবিষ্যতে এমন বিষয় সামনে আসলে সবাইকে ভেবে দেখতে হবে। আমাদের যে নীতি-আদর্শ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য না হলে তো ঐক্য করা যাবে না।

আপনাদের ডাকে তরুণ প্রজন্ম সাড়া দেন না কেন?

ইদানিং তরুণ প্রজন্ম যেভাবে জাগ্রত হয়েছে, আমাদের ডাকে সাড়া দিল কি দিল না এটা গুরুত্বপূর্ণ না। তারা যে সচেতন, এটা বোঝা যাচ্ছে। সচেতন শক্তিও নেমেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন বলেন, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন বলেন, এটা তো খুবই উল্লেখযোগ্য। এতেই বোঝা যায়, সর্বদা তাদের বিবেক জাগ্রত।

নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই আপনাদের তৎপর দেখা যায়। অন্য সময় এ নিয়ে সরব দেখা যায় না কেন?

আমরা তো আগাগোড়া এটা বলে আসছি, চেষ্টা করে আসছি। হয়তো যেভাবে সফল হওয়ার কথা, আমরা হইনি। কেন না, কিছু কিছু লোক যখন মন্ত্রী-টন্ত্রী হয়ে যায়, তখন কি করা। যেমন: রাশেদ খান মেনন আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ এ রকম বহুলোক আমাদের মধ্যে ছিলেন। কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন, তারপর তারা মন্ত্রী হয়েছেন। বলার কিছু নাই, সবাই নিজে নিজের ইচ্ছায় এসব করেছেন।

কেমন নির্বাচন হলে সেটি গ্রহণযোগ্য মনে হবে? নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হলো?

আমরা যে ৭ দফা দিয়েছি, ওটার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এগুলো আপনি ব্যাখ্যা করলেই সব জবাব পেয়ে যাবেন। আপনার প্রথম প্রশ্নের জবাবে দফাগুলো সংক্ষেপে বলে দিয়েছি। তবে নির্বাচনের বিষয়ে যা বলেছি, তা হলো— অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচনী আইনের মৌলিক সংস্কারসহ নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত ও কার্যকর ক্ষমতা সম্পন্ন একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।