রাত পোহালেই পর্দা উঠছে বিপিএলের

মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ঠিক উত্তর দিকেই বিসিবি একাডেমি। তার পাশেই একাডেমি মাঠ এখন প্রায় সারাদিন ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, ফ্র্যাঞ্চাইজি, টিম বয়, স্টাফ আর মিডিয়া কর্মীতে ঠাসা। সকাল নয়টা থেকে শুরু করে বিকেল চারটা-সাড়ে চারটা পর্যন্ত একাডেমি মাঠ সরব ক্রিকেটারদের কলতানে। সকাল থেকে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত এই এক মাঠেই চলছে রংপুর রাইডার্স, ঢাকা ডায়নামাইটস, খুলনা টাইটান্স, কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়ান্স, রাজশাহী কিংস, চিটাগাং ভাইকিংস আর সিলেট সিক্সার্সের অনুশীলন।

দেশে বিদেশি ক্রিকেটারে ঠাসা তাই একাডেমি মাঠ। ইচ্ছেয় হোক, কিংবা অনিচ্ছায়- মাঠে ঢুকতেই দেখা হয়ে যাচ্ছে
ডেভিড ওয়ার্নার, আন্দ্রে রাসেল, অ্যালেক্স হেলস আর ইয়ান বেলের মত নামী তারকার সাথে। কিংবা আপনার গা
ঘেঁষে চলে যাচ্ছেন ইয়ান বেল, এভিন লুইস, আফ্রিদি, সুনিল নারিন, কাইরন পোলার্ড কিংবা মোহাম্মদ ইরফান
আর মোহাম্মদহাফিজরা।
শুক্রবার বিসিবি বিশেষ ব্যবস্থায় জুম্মার নামাজে মাশরাফি, মুশফিক, সাকিবদের সাথে দেখা মিললো
পাকিস্তানের অলরাউন্ডার মোহাম্মদ হাফিজেরও। আগামীকাল থেকে তাদের সাথে ক্রিস গেইল আর স্টিভেন
স্মিথের নামও যুক্ত হবে। মোটকথা, শেরে বাংলার ভিতরে গেলেই বোঝা যায় একটা বড় যজ্ঞ দরজায় কড়া নাড়ছে।
হ্যাঁ, যজ্ঞই বটে। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিপিএল রীতিমত মহাযজ্ঞ। রাত পোহালেই পর্দা
উঠবে সেই মহাযজ্ঞের।
৫ জানুয়ারি, শনিবার গতবারের চ্যাম্পিয়ন রংপুর রাইডার্স আর চিটাগাং ভাইকিংসের ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে এবারের
বিপিএলের ময়দানি লড়াই। একইদিন সন্ধ্যায় (বিকেল ৫টা ২০ মিনেটে শুরু) দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হবে ঢাকা
ডায়নামাইটস ও রাজশাহী কিংস।
ক্রিকেটে আজকাল ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর বিশেষ করে ২০ ওভারের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট বেশ জনপ্রিয়।
ভারতের ‘আইপিএল’- অস্ট্রেলিয়ার ‘বিগ ব্যাশ’- সন্দেহাতীতভাবেই বিশ্ব ক্রিকেটের আলোচিত ও সাড়া জাগানো
ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। ওই দুই আসরকে এখন আর ঠিক ২০ ওভারের মোড়কে আটকে রাখা ঠিক হবে না।
বিশ্ব ক্রিকেটে আইপিএল এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট। ক্রিকেট বিশ্বের সব শীর্ষ তারকার
জ্বলজ্বলে উপস্থিতি, শত-শত কোটি টাকার খেলা আর বিগ বি অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, শিল্পা শেঠি, প্রিতি
জিনতা ও জুহি চাওলাসহ বলিউড তারকার অংশগ্রহণে আইপিএল এখন ক্রিকেট, বিনোদন আর বিপননে ভরপুর
এক সম্পূর্ণ প্যাকেজ। অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশ ঠিক সেই মানের না হলেও কম নয়।
আকারে আইপিএলের তুলনায় ছোট। বাজার, বিপণন, বাণিজ্য আর তারকার অংশগ্রহণ এবং অর্থের ঝনঝনানিও
অনেক কম। তবে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষপট দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশের বিপিএলও দিনকে দিন
ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টির বড় আসর হয়ে উঠেছে।

শুরুতে এটি একটি অগোছালো ও ভুলে এবং অনিয়মে ভরা এক আসর ছিল। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা, অনিয়ম,
ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক নিয়ে টালবাহানা এবং আয়োজকদের ত্রুটিপূর্ণ- ব্যবস্থাপনায় প্রথম চার আসরের
গায়েই আছে কালো দাগ। তবে তূলনামুলকভাবে পঞ্চম আসরটি তেমন বিতর্কের জন্ম দেয়নি। এবার ষষ্ঠ আসর
বিপিএলের।
ধারণা করা হচ্ছে এটাই হতে যাচ্ছে বিপিএলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আসর। বল পিচে গড়ানোর আগে সবচেয়ে
আকর্ষণীয় বলা কি ঠিক হলো? নিশ্চয়ই প্রশ্ন উঠছে। তা উঠতেই পারে। তবে কিছু প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবসম্মত
ইস্যুই বলে দিচ্ছে বিপিএলের এবারের আসরটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় হতে যাচ্ছে।
কারণ, প্রায় শুরু থেকে সর্বাধিক তারকার সমাবেশ ঘটতে যাচ্ছে এবার। ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, সুনিল
নারিন, এভিন লুইস আর পোলার্ডরা আছেন অগের মতই। এবার তাদের সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়া তথা
বিশ্ব ক্রিকেটের দুই বড় তারকা স্টিভেন স্মিথ আর ডেভিড ওয়ার্নার। এরই মধ্যে রাজধানীতে অবস্থান করছেন
ওয়ার্নার এবং স্মিথ।
একই সাথে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের সব সময়ের অন্যতম সেরা উইলোবাজ এবি ডি ভিলিয়ার্সও প্রথমবার
বিপিএল খেলতে আসছেন ঢাকায়। তাদের সাথে ইংল্যান্ডের অ্যালেক্স হেলস আর ইয়ান বেলসহ আরও বেশ কিছু
নামি-দামি তারকার দেখা মিলবে এবার।
বিপিএলে আগেও তারকার সমাবেশ ঘটেছে; কিন্তু শুরু থেকে এত বিপুল সংখ্যক বিশ্ব বরেণ্য ও নামি-দামি
ক্রিকেটার আগে কখনো বিপিএল খেলতে আসেননি। এটা একটা নতুনত্ব এবং বড় তাৎপর্য্য ও বৈশিষ্ট্য
এবারের আসরের। সে সাথে প্রচারণায়ও আসছে নতুনত্ব। অভিনবত্ব।
আগের আসরগুলোতে ক্যামেরার কাজ ভাল ছিল না। সেই অপবাদ ঘোচাতে ব্যস্ত আয়োজকরা। এবার ২৬ থেকে
৩৬টি ক্যামেরা ব্যবহারের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রথম পর্বে স্পাইডার ক্যামেরা না থাকলেও পরের পর্বেই
স্পাইডার ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। এছাড়া মানববিহীন ‘ড্রোন’ থাকবে এবারের আসরে।

সবচেয়ে বড় কথা আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পূনঃবিবেচনার সুযোগ থাকবে। মানে রিভিউ সিস্টেমও আছে এবার। বলার
অপেক্ষা রাখে না, আগে কখনোই রিভিউ সিস্টেম ছিল না বিপিএলে। সর্বাধিক তারকা, ক্যামেরা তথা প্রচার
ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং রিভিউ (ডিআরএস) সিস্টেম- সব মিলে নতুনের সমাহার।
কাজেই আয়োজকরা এখন পর্যন্ত কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। তবে একটি বিষয় চোখে পড়ার মত। তাহলো, খোদ
আয়োজক বিসিবি কর্তাদের নিস্পৃহতা। ঠিক নিষ্ক্রীয়তা বলা যাবে না। কারণ আয়োজকরা নিষ্ক্রীয় থাকলে
এতবড় আয়োজন সম্ভব ছিল না; কিন্তু গত কদিন মানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিপিএল নিয়ে খোদ বোর্ডে যতটা সাড়া পড়ার কথা ততটা চোখে পড়েনি।
বড় বড় তারকার মেলা বসার কারণে এবার আগে থেকেই বিপিএল নিয়ে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়া পড়ে গেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টা পর বেজেছে বিপিএল ডঙ্কা। গেইল, ওয়ার্নার, স্মিথ, ডি ভিলিয়ার্সদের নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত। একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে চারিদিকে। তাই হয়ত আয়োজকরা তেমন একটা নড়ে চড়ে বসছেন না।
আর তা যে বসছেন না, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো- এত বড় আয়োজনের আগে কোন অফিসিয়াল প্রেস
কনফারেন্সই হয়নি। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল বা বিসিবি থেকে একটি সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয়নি। এবারের আয়োজন সম্পর্কে প্রচার মাধ্যমের কাছে কোন আনুষ্ঠানিক বার্তাও পৌঁছে দেয়া হয়নি।
সে কারণেই এবারের প্রাইজ মানি কত? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম সাংবাদিকরা। তবে জানা গেছে প্রাইজমানি বাড়েনি। এবারও চ্যাম্পিয়ন দল পাবে নগদ ২ কোটি টাকা।
উদ্বোধনী ম্যাচের আগের প্রেস মিট হলো খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে। যা রীতিমত দৃষ্টিকটু এবং বিপিএলের মানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যা আগে কখনো হয়নি।
বোঝাই যায়, বোর্ডের শীর্ষ কর্তাদের গায়ে এখনো নির্বাচনী উত্তাপ। বলার অপেক্ষা রাখে না বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, আর বোর্ড পরিচালক নাঈমুর রহমান দুর্জয় সরাসরি নির্বাচন করেছেন। পরিচালকদের বড় অংশও ব্যস্ত ছিলেন নির্বাচন নিয়ে।
নির্বাচন শেষ। এখন নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের তোড়জোড় চলছে। কিন্তু বোর্ডে আজ পর্যন্ত পরিচালকদের
উপস্থিতি মোটেই চোখে পড়েনি। পরিচালকরা যে বিপিএল নিয়ে খুবই তৎপর- তা বলারও অবকাশ নেই।
এমনকি বিপিএল নিয়ে একটি ছোট-খাট মিডিয়া সেশনও হয়নি। তা না হওয়ায় যে ক্রিকেট অনুরাগিরা খবর কম পেয়েছেন বা পাচ্ছেন, তা নয়। মিডিয়া হাউজগুলো দর্শক ও সমর্থকদের উৎসাহ-আগ্রহর কথা মাথায় রেখেই খবর ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেছে।