যে কোনো কবিই শুরু করেন আকস্মিক ভাবে: অসীম সাহা

কবি অসীম সাহা’র লেখালেখির জীবন শুরু ১৯৬৪ সাল থেকে। ১৯৬৫ সালে ঢাকার একটি দৈনিকে তার ছাপার অক্ষরের যাত্রা শুরু। সাহিত্যের সকল বিষয়ে তুখোড় এই লেখক সেই থেকে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর কবিতা, গান প্রভৃতি রচনায় সিদ্ধহস্ত।

কবি অসীম সাহা শুধু কল্পনার কবি নন, বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে লেখার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন কখনো নিরব প্রতিবাদের ভাষায়, কখনো সুখ-দুঃখ, প্রেম, প্রকৃতির স্পর্শে তুলেছেন কলমের ঝড়।

অসীম সাহা এখনও অব্যাহতভাবে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ভাষা ও ছন্দ নিয়ে অক্লান্ত কাজ করে চলেছেন। বাংলা অভিধানকে সহজবোধ্য করে তুলবার জন্য তিনি বর্তমানে বাংলা ভাষার সবচেয়ে সহজ অভিধান লিখছেন, যা বাংলা সাহিত্যে এক বিপ্লব ঘটাবে বলে তিনি এক আন্তরিক সাক্ষাৎকারে একথা জানান।

পদ্য লেখার গল্পটা বলুন । শুরু করলেন কিভাবে, কখন?
শুরু করলাম মানে …যে কোনো কবিই শুরু করেন আকস্মিক ভাবে। এটা কিভাবে হয় বলা খুব মুশকিল। তবে আমাদের বাড়িতে একটা সাংস্কৃতিক আবহ ছিল। আমার বাবা ছিলেন দার্শনিক মানুষ। ভারতের দর্শনের উপর তার বই আছে। আমার মা ছিলেন গায়িকা, আমার বোনের গায়িকা হিসেবে খ্যাতি ছিল, আমার নানা গান গাইতেন, আমার মামারা গান করতেন, আমার ওয়াইফ গান গায়।

ছোটবেলা থেকে শুরু করে মানে এই পর্যন্ত এসে পিতৃ পরিবার এবং শ্বশুরবাড়ির পরিবার এসব দিক থেকে একটা কালচারাল আবহ পেয়ে আমার বিকশিত হবার পথটা সহজ হয়েছে। ১৯৬৪ সাল থেকে লিখতাম, কিন্তু খুব একটা যে হতো তা না।

এরপর ১৯৬৫ এ কলেজে একবার আমার কাছে কবিতা চাইলো, আমি রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ কবিতা অনুকরণ করে একটা কবিতা লিখে পাঠালাম। তখন টিচার বললেন, তুমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুকরণ করেছো। তখন একটু লজ্জাও পেলাম বিব্রতও হলাম। মনে হলো, আমাকে কবিতা লিখতে হবে। এরপর আমি কবিতা লিখে লিখে পত্রিকায় পাঠাই কিন্তু ছাপা হয় না। এরপর আমি একটা গল্প লিখলাম ১৯৬৫ এর ১৪ই আগস্ট। গল্প লিখে রফিকুল হক দাদাভাই এর ‘দৈনিক পয়গাম’পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় আমার যাত্রা শুরু হলো ছাপার অক্ষরে।

তারপর থেকে ক্রমাগত লিখতে থাকলাম আর ঐ পত্রিকাতেই ছাপা হতে থাকলো এবং অন্যান্য পত্রিকায়ও প্রচুর পরিমাণে ছাপা হতে থাকলো।

আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু-ফর্ম নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন বা দুর্বলতা আছে? লেখার ক্ষেত্রে আপনি কোনটা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ?

না, না আমার কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে দুর্বলতা নেই। তবে, যখন আমি ১৯৬৭ এ প্রথম জীবনানন্দ দাসের কাব্য সংগ্রহ পাই, সেটা পেয়ে আমি দেখলাম এই প্রথম নতুন ধরণের কবিতা। তার আগেতো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইত্যাদি পড়েছি, তা অন্য ধরণের। তখন মনে হলো কবিতায় নতুন একটা প্রভাবের দরকার।

আমি তখন একটা কবিতা লিখলাম, আধুনিক গদ্য কবিতা বলতে যা বোঝায় তা-ই লিখলাম। কিন্তু তখনো ছাপা হয়নি। আমি ১৯৬৯-এ ঢাকায় চলে আসি। তখন একটা পত্রিকায় ছাপা হলো এবং এভাবেই আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু হলো।

তারপর থেকে তো অনর্গল লিখতে থাকলাম ভাল মন্দ মিলিয়ে। তখনতো আসলে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কবিতা লিখে নামটা ছাপা, পরিচিত হওয়া। যেটা হয় আর কি! এরপর আমার বন্ধু নিরঞ্জন অধিকারীরঅনুরোধে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলাম। এবং রবীন্দ্রনাথের উপর প্রথম আমি একটি প্রবন্ধ লিখলাম জগন্নাথ হল বার্ষিকীতে। তখন আমার প্রবন্ধের চাহিদা এতো বেড়ে গেলো যে, কেউ আর কবিতা চায় না শুধু প্রবন্ধ চায়। আমিও প্রবন্ধ লেখা শুরু করলাম, পাশাপাশি কবিতার জগতেও নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছি।

কবিতা লেখার জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। একটি ঘটনা বা অভিজ্ঞতা কী করে আপনি কাব্যে রূপান্তর করেন?

আমার একটা সিরিজ কবিতা আছে ‘উদ্বাস্তু’নাম। যেসব মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায় তাদের একটা যন্ত্রণা আছে। হারানোর যন্ত্রণা। মাতৃভূমি, শেকড় উপড়ে ফেলার যে যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণা যে যায় একমাত্র সে-ই বোঝে। তাদের এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে আমি ধারণ করার চেষ্টা করেছি। আমি দশটা সিরিজ কবিতা লিখেছি, দশটাই সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ওর মধ্যে উদ্বাস্তু জীবনের যে যন্ত্রণা এটাকে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি।

যেমন এবার একটা বই বের হয়েছে ‘পাঁজর ভাঙ্গার শব্দ’ অর্থাৎ দেশ ত্যাগ করে যে পাঁজর ভেঙ্গে যায়, তার যে হাহাকার তৈরি হয়, শুন্যতা তৈরি হয় তা ধরবার চেষ্টা করা। আমার সবগুলো কবিতা প্রায় ঐ ধরণের। ‘পাঁজর ভাঙ্গার শব্দ’ তার মধ্যে কষ্টগুলো প্রতিফলিত হয়েছে। আমার অনেক অনেক কবিতা, প্রচুর কবিতা আছে শুধু এই বিষয় নিয়ে। যেমন ভারত থেকে এখানে চলে এসেছে, এখান থেকে ওখানে চলে গেছে এসব বিষয় নিয়ে।

আর এমনিতে প্রেমের কবিতা তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আছে। ব্যক্তিগত প্রেম থেকে আসে, কল্পিত প্রেম থেকে আসে, অন্যের প্রেম থেকে আসে। কখন প্রেমের কবিতা কিভাবে আসবে বলা যায় না।

ব্যক্তিগত, কল্পিত প্রেমের সাথে যেভাবে কবিতা অঙ্কুরিত হয় এমন দু’একটা সুখ স্মৃতির কথা যদি শোনাতেন কবি …

আমি ১৯৬৯ সালে একটা রেলস্টেশনে বসে আছি, জানালার ধারে দেখলাম একটি মেয়ে বসে আছে। খুব সুন্দরী, চোখে স্নানগ্লাস। তাকে আমি চিনিনা। দূর থেকে একঝলক দেখা। ওর দিকে তাকিয়েছিলাম, ট্রেনটা আস্তে আস্তে চলছে……। ঐটার উপর আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম।

আবার চিটাগাং আমি গেলাম কবিতা পড়তে। সেখানে পাহাড়ের উপরে বিভা নামের একটি মেয়ের সাথে পরিচয়। খুব অল্প সময়ের পরিচয়, অল্পসময়ের কথা। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেই রাতেই চিটাগাং চলে যাই। ওর সাথে আর দেখা হয়নি। তো আমি বিভা নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম।

অতএব কবিতা এইভাবে আসে একঝলক দেখা। তার সাথে প্রেম হতেই হবে,শা রীরিক সম্পর্ক হতে হবে নট নেসেসারি। কাজেই কল্পনার মিশেল দিয়ে যে কবিতা রচনা করতে পারেন, তার বাস্তবসম্মত রূপক একটা তৈরি করতে পারেন সে আসল কবি। এখানে শুধু আমার কথা বলছিনা, প্রত্যেক কবিই তাই।

লেখক কবিদের দশক বিচার প্রচলিত আছে । আপনি আপনার দশককে কিভাবে উপস্থাপন বা চিহ্নিত করছেন?

আমি ব্যক্তিগতভাবে দশক বিশ্বাস করি না। তবে দশক যদি বলি, আমাদের দশকটা হচ্ছে একটা সবচেয়ে সমৃদ্ধ দশক এর ভেতর সন্দেহ নেই সবাই স্বীকার করবে, যারা সমালোচক তারাও স্বীকার করেছেন। ষাটের দশক হচ্ছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক এবং সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। এই সময়টাতে আমাদের সব চেয়ে বড় লেখক যারা আছে্ন, তারা এসেছেন। যেমন – রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, শিকদার আমিনুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, নুরুল হুদা, হাবিবুল্লাহ সিরাজি, আবু কায়সার, আমি, মাহাবুব সাদিক … যতবলি এরকম আরও আছেন। এরা সবাই হচ্ছেন ষাট দশকের।

লেখার জন্য প্রিয় সময় কোনটা?
রাত। সবসময় রাত। আমি দিনের বেলায় পারতো পক্ষে লিখিনা। রাত বারোটার দিকে শুরু করি, এরপর ৩টা-৫টা পর্যন্ত লিখি। আমি দিনের বেলায় লিখতে পারি না। যখন নিরব নিঃশব্দ থাকে, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে আমি তখন একা জেগে থাকি।

প্রকৃতির কোন উপাদানটি আপনাকে চমৎকৃত করে, ভাবায়?
যেমন রবীন্দ্রনাথের কিন্তু বর্ষা ঋতু খুব পছন্দ। বর্ষা ঋতু আমার ঘরের মধ্যে থাকলে পছন্দ কিন্তু বাইরে বেরুলে আমার একদম পছন্দ না। এটার দুটো দিক আছে – বর্ষার সৌন্দর্য একটা অন্যরকম আছে বটে, সেটা আমি যতটা দেখে আমি অনুভব করি বা ভাল লাগে। আবার যখন ভাবি এই বর্ষণের ফলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় তখন আর আমার ভাল লাগে না। যারা দূরে থেকে শুধু সৌন্দর্য দর্শন করতে চায়, যেমন চাঁদ দেখা জ্যোৎস্নার আলো উপভোগ করা এসব আমরা চাঁদের কাছে না গিয়েও পেয়ে থাকি। রবীন্দ্রনাথও ঐভাবে দেখেছেন। আমি এটা খারাপ অর্থে বলছিনা। আর আমরা যারা আজকের কবি, তাদের সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক অনেক বেশি গভীর। সেকারণে এসব উপেক্ষা করে কবিতাকে শৈল্পিকভাবে শিল্পমণ্ডিত করবো এটা মেনে নেয়া যায় না, আমি অন্তত মানতে পারি না। যে কারণে এগুলো আমাকে ভাবায়, কষ্ট দেয়।

তবে নির্দিষ্ট করে আমি খুব পছন্দ করি ঐ সময়টা যে সময়টা খুব বৃষ্টি থাকে না, আবার গরমও থাকে না, শীতও থাকে না অর্থাৎ নাতিশীতোষ্ণ সময়টা আমার পছন্দ।

আপনার আলোচিত কাব্যগ্রন্থ কোনগুলো?

আমার আলোচিত কাব্যগ্রন্থ কোনটা সেটাতো আমি বলতে পারবো না। তবে আমার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ যেটা- যেখানে আমি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি অনেক বেশি। যেটা বাংলাদেশে এখনও হয়নি ওটা হচ্ছে ‘ম বর্ণের শোভিত মুকুট’। ওখানে আমি ব্যাকরণ, ছন্দ, ভাষা প্রভৃতিকে নিয়ে প্রেমের কবিতাকে মণ্ড বানিয়েছি। কতটা কী হয়েছে জানিনা তবে এটায় আমি কাজ করেছি।

এক বসায় লিখেন? না কাটা ছেড়া করে না ধীরে ধীরে কেটে ছিড়ে লিখে থাকেন?

আমি এক বসায় লিখি। সেটা গল্প হোক, কবিতা হোক আমি পারতপক্ষে চেষ্টা করি এক বসায় লিখতে। ব্যতিক্রম হয় না তা নয়। তবে যতক্ষণ লেখা শেষ না হয় আমি অস্থির থাকি। আর বিশেষ করে যখন গদ্য লিখতে যাই তখন সঙ্গতি হারিয়ে ফেলবার ভয়ে শারীরিক যত কষ্টই হোক আমি লিখে ফেলি।

আপনি কি মেটাফোর? অর্থাৎ নিজস্ব শব্দ তৈরি করেন?

হ্যাঁ আমি শব্দ তৈরি করি। যেহেতু কবিতা লেখার পাশাপাশি ভাষা, ছন্দ নিয়েও কাজ করেছি এবং কাজ করছি এজন্য আমি শব্দ তৈরি করি। যেমন এই মুহূর্তে আমি বাংলা ভাষার সবচেয়ে সহজ অভিধান লিখছি। এর আগে এতো সহজ অভিধান লেখা হয় নাই। আগামী ফেব্রুয়ারিতে আশা করছি বের করতে পারবো এবং আশা করি বাংলা সাহিত্যে একটা বিপ্লব হবে।

কবি অসীম সাহার ব্যক্তিগত জীবন, সংসার, প্রেম বিয়ে সম্পর্কে আপনার পাঠকদের কিছু বলুন । বৌদির সাথে কি প্রেমের বিয়ে ছিল?

হ্যাঁ। আমি প্রেম করেছি। এটা প্রেম বলা যায় কি না জানিনা তবে একধরণের মোহ তৈরি হয়েছিল। ওটাকে ঘোরও বলা যেতে পারে। কারণ আমার বয়স তখন মাত্র ১৯ ছিল আর আপনাদের বৌদির বয়স ছিল ১৪। অপরিণত বয়সের কারণে আমাদেরকে পুলিশ ধরতে এসেছিল। এটা মাদারীপুরের ঘটনা। আমরা পাশাপাশিই থাকতাম। আমাদের বাড়ির পেছনে ওরা থাকতো। আমাদের উঠোন দিয়ে ও প্রতিদিন স্কুলে যেতো। ওভাবেই আমাদের একটা ভাললাগা তৈরি হয় এবং আমরা দু’জন পালিয়ে যাই।

আমাদের সহযোগিতা করে ওর বান্ধবীরা আর আমার দুই বন্ধু। পালিয়ে গিয়ে আমি মামার বাড়িতে উঠি। তারা আমাকে খুব হেল্প করে। এরপর বাড়িতে যখন ফিরে আসি তখন আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। পুলিশ এসে বলে- আরে, এই বয়সে তোমার এতো সাহস!এইটুকু বয়সে তুমি এইটুকু একটা মেয়েকে বিয়ে করেছ!

তবে যেহেতু দুজনের অভিভাবক রাজি ছিল তাই পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারে নি।

এখন আমাদের বিয়ের ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা আগে যেমন ছিলাম তেমনি আছি, সেরকমই থাকতে চাই। সেরকমই থাকবো। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই যে, গভীর প্রেম কখনো ভুল জায়গায় পড়ে না। আমার ঘরে যিনি আছেন তিনি আমার জীবনের জন্য এতোই উপযোগী, যে কারণে আমাকে কখনোই ডানে বায়ে তাকাতে হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।

আমি তার কাছে ঋণী এজন্য যে, আমার স্ত্রী আমার বয়সে অনেক ছোট হলেও আমাকে জীবনের সমস্ত বিপদে আপদে আড়াল করে রেখেছে এই একটি মাত্র মানুষ।

আপনি সুস্থ শরীরে দীর্ঘজীবী হোন। অনেক অনেক শুভকামনা। আপনাদের জন্য আমার শুভাশিষ।