মানুষ কোথায় গিয়ে একটু নিরাপদে বসবাস করবে?

শারমীন ইসলাম সাথী: বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান সেদিন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘মানুষের মতো ভয়ের জীব পৃথিবীতে আর নেই। মানুষ যে কখন কী বলবে, কখন কী করবে, মানুষ নিজেই জানে না। কখনো কখনো বাঘের ভয়ংকর থাবার চেয়েও মানুষের একটি কথা বা একটি কাজ অনেক বেশি ভয়ংকর মনে হয়। মানুষকে সভ্য হতে কতো ধর্ম, কতো নিয়ম, কতো রীতি, আইন, প্রযুক্তি, শিক্ষা, কতো কিছু জানতে হয়, মানতে হয়।’

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে সভ্যতার এই বিকাশ। ছোট বেলায় দেখেছি বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুৎ চালিত ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ এগুলো তো অনেক পরের কথা৷ নিজের চোখেই দেখলাম কীভাবে বিদ্যুৎ আসলো ঘরে। ঘর আলোকিত হলো বৈদ্যুতিক বাল্বে, এরপর প্রবেশ করলো ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ প্রভৃতি। প্রযুক্তির ব্যবহার এখন আর শহরকেন্দ্রিক নেই, ছড়িয়ে পরছে গ্রামে গ্রামে। প্রায় সবার হাতেই এখন মোবাইল ফোন। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ নানা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ঘরে ঘরে।

আমাদের দেশে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে এসেছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। তবুও দেশের মানুষ সভ্য হলো কোথায়? এ দেশে আইন আছে, তা ঠিকমতো মানা হয় না। ট্রাফিক আইনের কথাই যদি বলি, কতজন তা মানছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে বা টিভিতে সড়ক দূর্ঘটনায় মানুষজনের নিহত বা আহত হওয়ার সংবাদ দেখছি। কয়েকদিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে চললো ঐতিহাসিক কিশোর আন্দোলন

পত্র-পত্রিকায়, টিভিতে, ফেসবুকে দেখলাম লেন মেনে গাড়ি চালানোর ছবি। আন্দোলন থেমে যাওয়ার সাথে সাথে সে চিত্রও থেমে গেল। এতো গেল বাইরের নিরাপত্তাহীনতার কথা। ঘরে কি আমরা নিরাপদ? সেদিন ফেসবুকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, ‘আমার ছেলে ও স্ত্রী এখন আল্লাহর রহমতে ভাল আছে।’ মন্তব্যে দেখলাম, তার স্ত্রীকে কাজের মহিলা দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়েছে।

এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে একটু নিরাপদে বসবাস করবে? আমরা প্রতিনিয়ত ঘরে বাইরে সংগ্রাম করে চলছি একটুখানি নিরাপদ বসবাসের জন্য। এই অস্থির সময়ে আমাদের মন জুড়েও রয়েছে অস্থিরতা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বিনোদন বা প্রয়োজনের পাশাপাশি অস্থিরতাও বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। যেমন, ফেসবুকে দশ মিনিটের মধ্যেই দেখে ফেলছি প্রায় বিশ ত্রিশ জন বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিত জনের মানসিক, শারীরিক, পারিবারিক কিংবা সামাজিক অবস্থানের স্ট্যাটাস বা ছবি।

যার ফলে দৈনন্দিন কাজ কর্মে মনোযোগ কমে আসছে। কমে আসছে উৎপাদনশীলতা। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের অস্থিরতা, অনিরাপত্তা বাড়বে বৈকি কমবে না। আমরা সন্তানদেরকে ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দেই। ভিডিওগুলো ওদের জন্য কতটুকু উপযুক্ত সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওদের বেড়ে ওঠার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এতে করে ভবিষ্যত প্রজন্মের বোধ, বিচারবুদ্ধি কোন দিকে যাবে এ ব্যাপারে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

জাতিগতভাবে আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিকই কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও রয়ে গেছে অমীমাংসিত। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা নিমিতার্থে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দেয়া জরুরি। নিরাপত্তাই হোক প্রথম গুরুত্ব – এই বাক্যটি উপলব্ধি করে সমাধানের পথে দেশ ও দেশের মানুষ এগিয়ে যাক এটাই কাম্য।

লেখক : গবেষক।