বেড়েছে আর্থিক কষ্ট: লকডাউন সংক্রমণ ঠেকাতে কতটা কাজে লেগেছে?

মাত্র দুই সপ্তাহরে মধ্যেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি বেশ দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে এরই মধ্যে পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ।

সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’ তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরে পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলো।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার এখনো পুরোমাত্রায় শুরু হয়নি, যদিও আক্রান্তের সংখ্যা শুক্রবার পর্যন্ত ১৮৩৮জন।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী সনাক্ত হবার ১৭ দিন পরে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সংক্রমণ ঠেকানো।

কিন্তু গত এক এক সপ্তাহের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা দুটোই বেশ দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এমন অবস্থায় আগামী ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত বিধিনিষেধ বজায় থাকবে।

গ্রামাঞ্চলের কৃষক দিশেহারা
কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে রীতিমতো সংগ্রাম করছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় গ্রামাঞ্চলের কৃষক এখন দিশেহারা। মুন্সিগঞ্জের সবজি চাষি আখতার দেওয়ান বলছিলেন, বিক্রি নেই তাই উৎপাদিত সবজি মাঠেই পড়ে আছে।

“মাল বিক্রি করতে পারতেছি না। যদি ঢাকায় মাল পাঠাইতে না পারি,তাহলে মাঠ থেইকা সবজি তুলে লাভ কী?” মি: দেওয়ান বলেন।

একই অবস্থায় আছেন সাভারের রাজিয়া সুলতানা। তার ফার্মে উৎপাদিত দুধ মিষ্টির দোকানে বিক্রি হতো। লকডাউনের কারণে এসব দোকান বন্ধ থাকায় এখন রাজিয়া সুলতানার মাথায় হাত। “দুধের কেজি যেখানে ৬০ টাকা ছিল, সেইটা এখন ৩০ টাকা নেমে আসছে,” বলছিলেন রাজিয় সুলতানা। পৃথিবীর বহু দেশ এখন অর্থনীতির চেয়ে জনস্বাস্থ্যকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

অর্থনীতি না জীবন?
আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন পদ্ধতি কাজ করেছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য এটিই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের সরকার জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বিধি-নিষেধ আরোপ করলেও মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভীত নড়ে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

কিন্তু তারপরেও কোন উপায় দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরা। ঢাকার বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক পূরবী দেবনাথ বলছিলেন, অর্থনীতির বিবেচনায় এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে হালকা করে দেখার মোটেও সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সেজন্য সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশের জন্য লকডাউন পদ্ধতি অন্যদের চেয়ে বেশি কার্যকর। “অর্থনীতির চেয়ে জীবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ,” বলছিলেন পূরবী দেবনাথ।

ভ্রমণে সংক্রমণের ঝুঁকি
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ‘লকডাউন’ কিছুটা হলেও কাজে লেগেছে। কিন্তু এই ‘লকডাউন’ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে হতাশা প্রকাশ করেন এক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সে কর্মকর্তা বলেন, লকডাউনের মধ্যেও বিভিন্ন আক্রান্ত এলাকা থেকে মানুষজন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছে। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে বেশি।

তাছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণের বিতরণের জন্য যেভাবে মানুষ জড়ো করা হয়েছে সেটিও সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। এছাড়া বিভিন্ন হাট-বাজারে অনেকেরই সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি মেনে চলেননি।

গার্মেন্টসকে অপেক্ষা করতে হবে
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষকে সংক্রমণের হাত থেকে যেমন বাঁচাতে হবে তেমনি অর্থনীতির কথাও চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলছেন, স্বাস্থ্য বিধি মেনে কৃষি এবং ক্ষুদ্র শিল্প থেকে উৎপাদিত পণ্য পরিবহন এবং বাজারজাতকরণের উপায় খুঁজে বরে করতে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন বোরা ধানের মওসুম। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শস্য। এ ধান কিভাবে মাঠ থেকে তুলে আনা যায় সেটি ভাবতে হবে বলে নাজনীন আহমেদ মনে করেন।

গার্মেন্টস শিল্পের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এখনো সেগুলো খুলে দেবার সময় আসেনি। এজন্য আরো তিন থেকে চার সপ্তাহ অপেক্ষা করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। গার্মেন্টস কারখানা খোলার পর শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

“ওনারা যে প্রোডাক্টটা ৫০০ জনকে দিয়ে তৈরি করান, সেখানে ৫০০ জন এখন নিয়োগ করলে হবে না,” নাজনীন আহমেদ বলেন।

”যেভাবে ওনারা ঘন-ঘন বসেন সেটা হলে চলবে না। এক সিট বা দুই সিট বাদ দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে দূরত্ব রেখে যাতে ওয়ার্কাররা বসতে পারে, ” তিনি বলেন।

প্রয়োজন হলে ২৫ এপ্রিলের পরেও দেশজুড়ে লকডাউনের সময়সীমা আরো বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন।

তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় দাবি করেছেন, আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সবাই যদি ঘরে অবস্থান করে তাহলে তার ভাষায় ‘করোনাযুদ্ধে জয়লাভ’ করা সম্ভব হবে।

কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ দাবির পক্ষে কোন যুক্তি সংগত কারণ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন বাংলাদেশে, করোনাভাইরাসের বিস্তার হয়তো মে মাসের শেষ পর্যন্ত চলতে পারে।