বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা হয়েছে সংক্ষিপ্ত পথে

আহমদ রফিক: ব্যক্তি জীবনে চিকিৎসক হলেও আহমদ রফিক মূলত কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ে গবেষণা তার বিশেষ কৃতিত্ব। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে রবীন্দ্রত্ত্বাচার্য উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বাহান্ন’র ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সম্প্রতি এই গুণী ব্যক্তি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বাংলাদেশের বর্তমান বাংলা ভাষা এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষাপট নিয়ে।

প্রশ্ন: প্রথম যখন সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন সে সময়ে সব থেকে বেশি পড়তেন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা । ঠিক কোন কারণে নজরুলের কবিতা আপনাকে টেনেছিল।

আহমদ রফিক : নজরুলের সবরকম কবিতা-ই যে টানত তা নয়। বিশেষত তার বিপ্লবী কবিতাগুলো আমি পছন্দ করতাম। সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগে আমার বয়স যখন ১৪-১৫ তখন ভারতের স্বাধীনতা একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল । মূলতঃ এ কারণে তাঁর কবিতা ভালো লাগত। নজরুলের কবিতা পড়লেই মনের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হতো। আমি যখন বুঝতে শুরু করি তখন থেকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে মানসিকভাবে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম।

প্রশ্ন: আপনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বলেছেন সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষী লেখক।

আহমদ রফিক : ঠিক কী কারণে বলেছি সেটি সাক্ষাৎকারে সম্পূর্ণ বলা কঠিন। বঙ্কিম যখন আমি প্রথম পড়ি তখন যশোরে ম্যালিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই মাস থাকতে হয়েছিল। সে সময়ে আমার বয়স খুবই কম। ওই সময়ে যে বেশকিছু বই পড়েছিলাম তার মধ্যে বঙ্কিমের দেবী চৌধুরানী, আনন্দমঠ, চন্দ্রশেখর পড়ে তাকে আমার অন্যরকম মনে হলো। তাঁকে মনে হলো মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক, প্রতিভাবান লেখক। সাহিত্য সম্রাট, বড় লেখক সবকিছুতেই আমি তাঁকে মানি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো উনি ভীষণ রকমের সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষী। পরবর্তী সময়ে আমার প্রথম যে প্রবন্ধের বইটি বের হলো তার আগে মনে হলো মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্কিমকে বিচার বিশ্লেষণটা করলে কেমন হয়। আমি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছি। আমার প্রথম বইটিতে বঙ্কিমের ওপর প্রবন্ধটাই সবথেকে বড় ৩২ পৃষ্ঠা। এই লেখাটি আবেগ নয়, তথ্য এবং তত্ত্বনির্ভর। তার উপন্যাস থেকে কোটেশান তুলে তুলে লেখা, যেমন “এই নেশাখোর নেড়েদের না তাড়াইলে হিন্দুধর্ম কিভাবে টিকিবে”, “হিন্দু এখানে অনায়াসে ধর্ম পালন করিতে পারিবে”। আরও এরকম কোটেশান। আমার পুরো মনে নেই। ওই প্রবন্ধটি পড়লে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হবে কোনো কোনো যুক্তি দিয়ে আমি তাঁকে সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষী লেখক বলেছি। তার আগে ভালো হয় তাঁর রচনাবলী পড়ে নিলে।আমি পুরোপুরি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। দাঙ্গা আমাকে আহত করেছে। হিন্দু কিংবা মুসলিম যা ই হোক, কারো সর্ম্পকে একটি অর্বাচীন মন্তব্য করলে আমি ক্ষুব্ধ হই।

প্রশ্ন: তারপরেও আমাদের মধ্যে সম্প্রদায়ের বিভেদটা আছে । পৃথিবীর প্রথম থেকেই মানুষের মধ্যে একটা ছিল। এটা তো আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না।

আহমদ রফিক : মানুষরে মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষয়টা আছে, এটি আমি অস্বীকার করছি না। ভাষাগত দিক থেকে মানুষের মধ্যে একটি বিভক্তি তৈরি হলেও মানুষকে মানুষরূপে দেখলে সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয় না। সব থেকে বড় সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে ধর্ম। আমার মনে হয় একমাত্র ধর্মের কারণেই মানুষ সাদা কালো ছকে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। ‘আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম’ এটা বলেই তো অন্য ধর্মের মানুষকে ছোট করা হয়। আমি বলি রবীন্দ্রনাথের সেই কথা— হয়তো মুখ ফসকেই তিনি বলে ফেলেছিলেন : ধর্মকর্ম থেকে নাস্তিকতা অনেক ভালো। এটা রবীন্দ্রনাথের কথা হওয়ার কথা নয়। তিনি ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ডে লেকচার দিতে গেলেন, বিষয়বস্তু হলো রিলিজিয়ান অফ ম্যান। বাংলায় লিখলেন মানবধর্ম। এবং সেসব জায়গায় বললেন মানুষের মনুষ্যত্বই হলো তার ধর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, ধর্ম নয়। অন্তত আমার ধর্ম নয়। তার গীতাঞ্জলি থেকে শুরু করে, গীতিমাল্য, গীতালি এবং নৈবেদ্য’র অংশত, এগুলোতে যে ভক্তিবাদ, সেই ভক্তিবাদ কিন্তু রক্ষণশীল নয়, সেখানে ঈশ্বর মানুষ প্রকৃতি, এক ত্রিভুজের মধ্যে। এবং ঈশ্বরকে তিনি মানুষের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। তার একটি বিখ্যাত গানের লাইন বলি : “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর/ তোমার প্রেম হতে যে মিছে”। তো সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটাকে দূর করা সম্ভব একমাত্র আমি যদি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি— মানবিক চিন্তা, মানবিক চেতনা। রবীন্দ্রনাথ বহু জায়গায় মানবধর্ম, মানবকল্যাণ, মানবপ্রকৃতি প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন।

প্রশ্ন: মওলানা ভাসানী একটি কথা বলেছিলেন : “ধর্মের মৌলিক সূত্রগুলোকে মেনে নিলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না”। আপনি কি মনে করেন না সাম্প্রদায়িকতা রোধে এই কথা যুক্তিযুক্ত?

আহমদ রফিক : মওলানা ভাসানী ছাড়াও অনেকে বলেছেন ধর্মকে নমনীয় পর্যায়ে এনে অর্থাৎ মানুষ হিসেবে মানুষকে গ্রহণ বাদ দিয়েও ধর্মের মৌল সূত্রগুলো মেনেও সাম্প্রদায়িকতা রোধ করা যায়। কিন্তু আমি এর সঙ্গে একমত নই। মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে না দেখে অন্য কোনোভাবে দেখলেই সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হবে। সেটা হতে পারে ধর্মীয় কিংবা জাতিগত।

প্রশ্ন: আচ্ছা, এই যে বলা হয় হিন্দু নাম মুসলমান নাম। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আহমদ রফিক : নাম কি কখনো ইসলামিক কিংবা হিন্দু হয় নাকি। নাম তো ভাষার ব্যাপার। ধর্ম আর ভাষার ব্যাপার তো আলাদা। ধর্ম হলো মৌলিক কাঠামো। আর ভাষা তো সময়ে সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বিকাশ লাভ করেছে। এবং আমাদের এই অঞ্চলের বাইরে নাম নিয়ে এরকম আর মাতামাতি দেখা যায় না। যে বাঙালি সে বাংলা নাম রাখবে, যে আফগান সে আফগানি নাম রাখবে, যে জার্মান সে জার্মান নাম রাখবে। নামের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক। এই বিষয়ে ধর্মের সম্পর্ক চিন্তা করা অযৌক্তিক।

প্রশ্ন: এর সঙ্গে আরও একটি ব্যাপার আমাদের মাথা কুড়ে খাচ্ছে, সেটি হলো বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলার অভ্যাস।

আহমদ রফিক : এটি তো অহরহ দেখা যাচ্ছে। রেডিও টেলিভিশন এমনকি দৈনন্দিন জীবনে এই বিষয়টি দেখা যাচ্ছে। এটি আমাদের জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। এগুলো অপসংস্কৃতির অংশ। নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশের চেষ্টা থেকে অনেকেই এগুলো করেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নাটক আছে যার নাম “দুই পুরুষ”। তো ওখানে একটি ডায়লগে নায়ককে বলা হচ্ছে আপনি যখন কথা বলেন খুবই শুদ্ধ বাংলায় বলেন। ইংরেজি বাংলা মেশান না। তখন উনার উত্তর হচ্ছে, দেখ আমি দুটো ভাষা-ই ভালো জানি, এজন্য একটার সঙ্গে আরেকটি মেশে না। আরও আরেকটি বিষয়, অনেকে মনে করেন ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বললে মানুষকে চমকে দেওয়া যায়। আমি টেলিভিশনের অনেক অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ করে দিয়েছি শুধুমাত্র এই কারণে। এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, টিভি টকশোতে কেউ কেউ কাউকে কথা বলতে দেয় না। এটাতো সুশীল আচরণ হলো না। বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা হয়েছে সংক্ষিপ্ত পথে, পাকিস্তান অর্জন সংক্ষিপ্ত পথে, স্বাধীনতা স্বদেশ অর্জন সেও সংক্ষিপ্ত পথে, এর ফলে হয়েছে কি— আমাদের মৌলিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক যে সুচর্চা, সেটাতে আমরা অভ্যস্ত হতে পারলাম না। হঠাৎ করে যদি কোনো কিছু পাওয়া হয়, সংক্ষেপে যদি কোনো কিছু পাওয়া হয়— সে পাওয়ার মূল্য থাকে না। ইতিহাসের দিকে দেখলে দেখা যাবে ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব হলো। দ্বিজাতিতত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক প্রস্তাব হলো, এটা বিস্তৃত হতে সময় লাগলো। আমি একটু হিসাব করে দেখেছি ৪২-৪৩ সালের থেকে বাংলাদেশের তথা এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এটির বিস্তার ঘটলো। ‘৪৫-এ এটা তুঙ্গে। ‘৪৬-এর নির্বাচনে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। মুসলমানের সব ভোট পেল মুসলিমলীগ, একমাত্র ফজলুল হক সাহেব দুইটা আসনে জিতলেন; চাখার এবং খুলনায়। এরকম উন্মাদনা বাঙালি মুসলমানের। এর পেছনে যে রাজনীতিকদের শুধু ধর্মীয় প্রচার ছিল তা কিন্তু নয়, এছাড়া বাংলা মুসলমান হিন্দুদের থেকে শিক্ষা দীক্ষাসহ বিভিন্নভাবে পিছিয়ে ছিল। এটাও ছিল সহজেই দুই জাতির বিভক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। আর এই পিছিয়ে থাকার জন্য যখন মুসলমানদের বলা হলো পাকিস্তান হলে তোমরা স্বর্গ পেয়ে যাবে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তখন তারা অন্ধের মতো সমর্থন জোগালো।

প্রশ্ন: সেই মোঘল আমল থেকেই তো এ অঞ্চলের মুসলমানেরা পিছিয়ে।

আহমদ রফিক : তা তো বটেই। ইতিহাস তো তাই-ই বলে। ইংরেজরা আসার আগে থেকেই মোঘল আমলে যদি চোখ রাখি দেখতে পাই— রামমোহন রায় খুব ভালো ফার্সি জানতেন, আরবি জানতেন। মোঘল আমলে ফার্সি ছিল রাজভাষা, এই ফার্সি শিখে প্রচুর হিন্দু দেওয়ানি, এটা সেটা নানা কাজ করে মোঘলদের কাছের হয়ে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়ে গেল। এরপর ইংরেজরা যখন ভারত দখল করল এবং বেশকিছুকাল পর রাজভাষা ইংরেজি করা হলো তখন প্রথমে এগিয়ে এলো হিন্দুরা। তারা ইংরেজি শিখে ফেলল। এরপর ইংরেজি শিক্ষার কারণে সহজেই ইংরেজ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার সুযোগ পেল। আর এর ফলে তাদের বংশপরম্পরায় এই ধরনের নতুন আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগল। ১৯ শতকের মধ্যেই তারা প্রচুর বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে গেল। তো এই বিত্ত বৈভবের জন্য তো আর হিন্দুদের দোষ দেওয়া যায় না। সেতো যখন যে সুযোগ পেয়েছে সে সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। ফার্সিকে দিয়ে যেমন কাজে লাগিয়েছে ইংরেজিকে দিয়েও তেমন কাজে লাগিয়েছে। এদিকে মুসলমান সমাজ নাট সিঁটকে পিছিয়ে থাকল সবসময়। এজন্য ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের দুই আলাদা ধর্মের মানুষের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হলো। আবার পরবর্তীতে মুসলমানরা এই বৈষম্যের দায়টা চাপিয়ে দিলো হিন্দুদের ওপরে। বলা হলো তারা সকল ভালো জায়গাগুলো দখল করে আছে, আমাদের সুযোগ দিচ্ছে না।

প্রশ্ন: এসবই কি সহজেই মুসলমানদের পাকিস্তান হওয়ার পক্ষে যাওয়ার কারণ?

আহমদ রফিক : সেটা তো অবশ্যই। মোটা দাগে এটাই মূল কারণ।

প্রশ্ন: একটু একাত্তরের আগের কথা বলি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ৬০-এর দশকের শেষের দিকে সবকিছুতেই বাঙালিয়ানা প্রকাশের একটি জোয়ার শুরু হয়েছিল। এটি বাঙালিদের মধ্যে, বিশেষত পরবর্তীকালে বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশিদিন স্থায়ী হলো না কেন?

আহমদ রফিক : হ্যাঁ, এই জোয়ারটা এসেছিল ষাট দশকের শেষ দিকে। তখন পরিবারে বাংলা নাম রাখার চল শুরু হয়েছিল। আমার বড় ভাইয়ের তিন মেয়ে, সবার নামই যাতে বাংলায় রাখা হয় সেজন্য আমাকে নাম রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আমি নাম রেখেছিলাম যথাক্রমে : রেবা, রেখা, ঝর্ণা। ওই সময় সমস্ত সাইনবোর্ড লেখা হতো সম্পূর্ণ বাংলায়। ইংরেজি শব্দ বাংলা অক্ষর দিয়ে নয়, বাংলা নাম রাখার জোয়ার সে সময়। লুঙ্গি ধুতি এবং শাড়ি পরার চল বেড়েছিল। আবাসনের নাম বাংলা, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলা রাখা হতো। সেসব চেতনা এখন হাওয়ায় উড়ে গেছে। এর কারণ হলো আমরা অনেককিছু সহজে পেয়ে গেছি। আমাদের নিজস্বতা জিইয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করার আগেই সহজে আমরা দেশ পেয়ে গেছি। অতি সহজে কিছু পেলে তো তাকে মূল্যবান মনে হয় না। বাংলাদেশিদের এই সমস্যা হয়েছে। সে আসলে পুরোপুরি উপলব্ধি পারে না নিজের সত্ত্বাকে। যুদ্ধটাও যদি সংক্ষেপে শেষ না হয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হতো তাহলে ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে একটি বোধ পাকা হতো, যে কত দামে আমরা এটাকে অর্জন করেছি। মুখে বলি লক্ষ শহীদ, হৃদয় দিয়ে সেটি অনুভব করলে নিজে থেকেই তো বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতাম না। সবখানে বাংলা ব্যবহার করার চেষ্টা করতাম। বাঙালিয়ানার চর্চা করতাম। মনে করতাম না যে— কথার মধ্যে দুইটা ইংরেজি বাক্য বলা মানে আধুনিকতা।

প্রশ্ন: এই বোধটা পাকা হলে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা কি দূর হতে পারতো?

আহমদ রফিক : তাতো পারতোই। এখন যারা চোখে আলাদা করে হিন্দু-মুসলমান দেখে তারা একযোগে সবাইকে বাঙালি হিসেবে দেখত। ভাষা নিয়ে আজকের যে সংকট, সাংস্কৃতিক শূন্যতা কিছুই থাকত না।

প্রশ্ন: আর আমাদের সাহিত্যকর্মে গবেষণার যে অভাব সেটা রোধের উপায়?

আহমদ রফিক : এটা গবেষকদের উপলব্ধি করা উচিত। আমাদের দেশে অনেক ভালো অধ্যাপক এবং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভালো ছাত্র আছে, কিন্তু তেমন কাজ হচ্ছে না। আমাদের সাহিত্যকর্মে গবেষণার খুবই অভাব। যা ই বলি না কেন, পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু সাহিত্যের গবেষণায় আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। আমি নিজেই একটি কাজ খুব আশা করেছিলাম যে আমাদের কেউ করবে। কেউ করল না। শেষ পর্যন্ত আমি অনেকদিন পরিশ্রম করে করলাম। এটি হলো দেশবিভাগ। ইংরেজি ভাষায় আমাদের এই দেশবিভাগ, দাঙ্গা রক্তপাত, মানুষহত্যা এগুলোকে সাউথ এশিয়ান ট্রাজেডি বলা হয়েছে। এই বিষয়টি মিশে আছে আমাদের ইতিহাস এবং জাতিসত্তার সঙ্গে । আমাদের দেশে প্রচুর ইতিহাসের ভালো অধ্যাপক আছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আছেন, সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আছেন এদের মধ্যে একজন অধ্যাপকও এই সাউথ এশিয়ান ট্রাজেডি নিয়ে কোন থিসিস করেননি। পিএইচডি তো দূরে থাক। অন্তত গবেষণা কর্ম করে একটি বই লেখা সেটিও করেননি। এই কাজটি আমার করতে হয়েছে। “দেশবিভাগ এবং ফিরে দেখা” নামে একটি বই লিখেছি। এই বইটি অনেক পরিশ্রম করে লেখা। আমি আশা করেছিলাম আমাদের ইতিহাসের গবেষকবৃন্দ এটি নিয়ে কাজ করবেন। কেউ করেননি। শেষমেষ খাটুনি করে আমাকে একটি বই লিখতে হলো।

প্রশ্ন: এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আহমদ রফিক : তোমাকেও।