‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে আধিপত্যবাদ নীতি পরিহার করতে হবে’

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, বাংলাদেশে এখন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশের সব ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন- ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন কিভাবে হবে তা নির্ধারণ করেছে ভারত। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে অংশ নিতে ভারত বাধ্য করেছে। ভারতের কংগ্রেস, বিজেপি ও বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ একইরকম জিনিস চায় বলে মনে করেন দুদু।

সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ রিসার্চ সেন্টারের উদ্যোগে ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক’’ এর ওপর গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের গবেষণা দপ্তরের পরিচালক শফিউল আলম।

বাঙালি তোষামোদি জাতি না উল্লেখ করে দুদু বলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। যে কোনো জাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতার করার মেধা সক্ষমতা বাঙালির আছে। কিন্তু সেটা আজ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্র হারা করেছে আওয়ামী লীগ। এর থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রশ্নে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের আলোচনা এবং ভারতীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে বৃহৎ প্রতিবেশীর রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আরও আলোচনার আশ্বাস ছাড়া বিশেষ কিছু কি পাওয়া গেল? বহুল আলোচিত আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানের প্রশ্নেও কি সহযোগিতার পুরোনো আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছু মিলল? আমরা ভারতকে বেশি দিচ্ছি আর পাচ্ছি কম বলে যে ধারণা চালু আছে, এ সফর সে ধারণা বদলে দেবে এমনটি নিশ্চয়ই কেউ আশা করেননি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে আধিপত্যবাদ নীতি পরিহার করে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংকটের অন্যতম বড় কারণ, ভারতের আধিপত্যবাদী নীতি। দুই দেশের সম্পর্ক কেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে ভারত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর নিয়ে তার নিজের কথার মধ্যেই আগের আত্মবিশ্বাস দেখা যায়নি।

সাইফুল হক বলেন, ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য যখন আমরা ভারতকে ধন্যবাদ ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই, কিন্তু যখন তারা সীমান্তে লাশ ঝুলিয়ে রাখে, তখন চুপ করে থাকার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ ও ভারত প্রতিনিয়ত বলছে, ‘বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক সব সময়ের তুলনায় উষ্ণ’। কিন্তু সীমান্তে ভারত পাখির মতো মানুষ হত্যা করতে দ্বিধা করে না। ইলিশ ও জামদানি উপহার দিয়ে ভারতের মনোভাব পরিবর্তন করা যাবে না। সাইফুল হক বলেন, আমরা ঔদার্য দেখাতে কম করিনি। কিন্তু তারা বাংলাদেশকে স্যাটেলাইট রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর মনোভাব অব্যাহত রেখেছে। আমরা তাদের সঙ্গে সমতা, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক চাই। ভারতের আনুগত্য থেকে ক্ষমতায় থাকার চিন্তা ভয়াবহ উল্লেখ করে ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ যদি মনে করে এভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারবে, তাহলে সেটা বিপদজনক হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিগত ১৪ বছরে তিনটা নির্বাচন হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সঙ্গে সব থেকে ভালো সম্পর্ক ছিল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দুটো কার্ড ট্রানজিট আর ৭১ সালের ঐক্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুকৌশলে ভারত ট্রানজিটকে ‘কানেকটিভিটি’ নাম দিয়েছে। আমরা সেই কানেকটিভিটি ছাড়াও চিটাগং পোর্ট তাদের দিয়েছি। কিন্তু ভারত দেশের সঙ্গে সম্পর্ক না করে বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। এটা ভুল নীতি।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, একটি বিষয় অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে, বাংলাদেশের ভেতরে কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি তোলার জন্য ভারতের কাছে অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এই যে চুক্তি করা হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনার জন্য, এটা ভুল ও খারাপ একটি দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ স্থাপন করল। এখন ভারত যদি বলে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ১৫৩ কিউসেক পানি নিতে পারবে, বাকি পানি ভারতের। এ চুক্তির অজুহাতে ভারত বাকি পানি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলে বাংলাদেশ কী করবে, সে বিষয়ে চুক্তিতে কিছু উল্লেখ আছে কি না, তা জানা জরুরি। এই চুক্তি ন্যায্য ও সঠিক হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ চুক্তিতে পুরো অববাহিকার পানি ও পলি কীভাবে ব্যবস্থাপনা হবে, তার উল্লেখ নেই। চুক্তিতে এমন কোনো বিধান নেই, ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে যে পরিবেশগত ক্ষতি করা হয়েছে, তার জন্য তারা ভর্তুকি বা ক্ষতিপূরণ দেবে কিনা। ভবিষ্যতে এ রকম প্রকল্প নিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে কি না। উন্নয়নের জোয়ার বেশি বোঝানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৫৩ কিউসেক পানি দিয়ে ১০ হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদের কথা বলেছে। আসলে এই পানি দিয়ে ৩ হাজার ৭০০ হেক্টরের বেশি জমি চাষাবাদ করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল আশরাফ (অব.) বলেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তারা পানির ন্যায্য হিস্যা কখনোই দেয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের অবস্থান অদ্ভূত। তারা বলেছে– বাংলাদেশকেও সমর্থন করে, মিয়ানমারকেও সমর্থন করে। একসঙ্গে মজলুম আবার জালিমকে সমর্থন করা যায় না। তারা বড় দেশ বলে দাদাগিরি করতে পারে না। বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা সব থেকে নিষ্ঠুরতম জায়গা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরাধী বলে গুলি করে মারবে এ ধরনের কোনো নিয়ম কোথাও নেই। ভারতকে অবশ্যই সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।