‘দুইডা মাইক্রোবাস আইসা অগোরে নামাইয়া লইয়া গেছে’

চট্টলানিউজ ডেস্ক: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল থেকে আজ সকালে তিন যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরে পরিবারের সদস্যরা এসে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে তাদের লাশ সনাক্ত করেন। স্বজনদের কান্নায় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে।

নিহতরা হলেন- রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকার মোহাম্মদ শহীদুল্লার ছেলে সোহাগ ভুইয়া (৩২), মুগদার মাণ্ডা এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে শিমুল আজাদ (৩০) এবং একই এলাকার আবদুল ওয়াহাব মিয়ার ছেলে নুর হোসেন বাবু (৩০)। তিনজনই রাজধানীতে ছোটখাট ব্যবসা করতেন। তাঁদের পরিবারে স্ত্রী, সন্তান ছিল। তাঁরা পূর্বপরিচিত। এক থেকে দুদিন তাঁরা পরিবারের বাইরে ছিলেন।

দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নানা ঘটনার মধ্যে এই তিন যুবকের লাশ পাওয়া নিয়ে নিহতদের স্বজনদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুজনের স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, দুজন একত্রে বাসে করে কোথাও থেকে ঢাকার দিকে আসছিলেন। তাদের সেখান থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়। তারপর থেকেই তাঁদের মোবাইল ফোনে আর যোগাযোগ করতে পারছিলেন না পরিবারের সদস্যরা।

যদিও রূপগঞ্জ থানা কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সদস্যদের সঙ্গে কারো কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেনি। অন্য কোনো বাহিনীর সঙ্গে এখানে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটলেও তাঁরা সেটি জানতেন। সে ধরনের কোনো ঘটনা তাদের জানা নেই। তবে একজনের পকেটে ইয়াবা পাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ।

‘বলছে বাসে উঠছি, এরপর থাইকা খোঁজ পাই নাই’
সোহাগ ভুইয়া ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকায় ডিসের ব্যবসা করতেন। তিনি গত বুধবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন। পরিবার বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে পায়নি। আজ শুক্রবার সকালে লাশের খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে এসে তাঁকে সনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা।

সোহাগ ভুইয়ার ভাই মোহাম্মদ শাওন (২৫) বলেন, ‘আমার ভাই ব্যবসা করত আরকি। ডিশের ব্যবসা করত। বুধবার থেকে আমরা খুঁইজা পাইতেছি না। খুঁইজা না পাওয়ার পরে আমরা, এলাকার সব জায়গায় খোঁজ-খবর নিছি, থানায় খোঁজ নিছি। তাঁরা (পুলিশ) বলতে পারে না। ডিবি অফিসেও গেছি, খবর পাই না। পরে শুনছি, পুলিশে নিয়া গেছে। কিন্তু তাঁর হদিস নাই। ডিবি নিয়া গেছে। পাই না, পাই না। আজকে আমরা নেটে, ফেসবুকে দেখলাম, ছবি। এরপরে আমরা আসলাম এই থানায়।’

এক প্রশ্নের জবাবে শাওন বলেন, ‘জিডি করা হয় নাই। কারণ আগে তো দুই, তিন দিন আমাদের খুঁজতে হবে। আমরা তো আগে খুঁইজা নিব। এরপরে শেনা আমরা ই করব।’

সোহাগ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না উল্লেখ করে তাঁর ভাই শাওন দাবি করেন, ‘আর শত্রুতাও ছিল না। আমার ভাই করত ডিশের ব্যবসা। ওই ব্যবসার ইয়ে হইতে পারে। ডিশের ব্যবসা যেহেতু করে অবশ্যই, কারণ আমাদের খারাপের লগেও ঘুরতে হয়। ঘুরতে কি, কথা বলতে হয়, লাইনের ব্যাপারে। ভালোর লগেও কথা কইতে হয়। এর জন্য যে এ রকম হবে। এটা আমরা আশা করি নাই।’ সোহাগের আরেক ভাই মোহাম্মদ শরিফ বলেন, ‘কেরে বা কারা ধরে নিছে জানি না। পরশু দিন ধরে নিছে। আজকে লাশ পাইছি।’

রূপগঞ্জ থানা কাম্পাউন্ডে সোহাগের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, ‘আমি কিছু জানি না যে, শত্রুতা ছিল বা কোনো কিছু। ও (সোহাগ) আমাকে বলছে, যে আমি কুষ্টিয়া যাইতেছি বেড়াইতে। আত্মীয়ের বাসায়। উনার নম্বর নিয়া দিছি যে ওইখানে দাঁড়াইয়া। ব্যাস, অতটুকুই জানি। আসার সময় বলতেছে, আমি বাসে উঠছি। এতটুকুই জানি। এরপর থাইকা আমি কোনো খোঁজ পাই নাই ওর। ওর কোনো খোঁজ পাই নাই।’

কান্নার একপর্যায়ে ফারজানা আক্তার বলেন, ‘যাচাই-বাছাই তো মানুষ করে। বা কোনো কিছু করে। আমি জানি এতটুকুই, ও বেড়াইতে গেছে। আমারে বলছে, আমি বেড়াইতে যাইতেছি। আমারে খালি বলছে, আমি বাসে উঠতেছি, তুমি গেটে তালা মাইরা রাখ। আমি সকালে আইসা তোমারে ফোন দিমু। এরপর থাইকা আমি কোনো খোঁজ পাই নাই। কালকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিছি। কোনো খোঁজ পাই নাই আমি।’ নিহত সোহাগের শ্যালক রবিন জানান, নিহতরা দুইজন বন্ধু ও আরেকজন সিনিয়ার।

যে গাড়িতে করে লাশ তিনটি হাসপাতাল থেকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে তার পাশে বসেই কাঁদছিলেন নিহত শিমুল আজাদের স্ত্রী আয়েশা আক্তার আন্নি। তাঁর ছোট একটি মেয়ে আছে। স্বজনরাও কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। এরই এক ফাঁকে আয়েশা বলেন, ‘দুই দিন ধইরা… কালকেত্তে (গতকাল থেকে) খুঁজতাছি, ফোন দিতাছি। খুঁইজা পাই না দেইখা, গাড়ি দিয়া কই জানি বেড়াইতে গেছে। আইতাছে। এরপর (মোবাইল) নম্বর বন্ধ।’

‘যেই গাড়ি দিয়া আইছে, ওই গাড়ির সুপারভাইজারে কইছে, দুইডা গাড়ি সামনে আইনা দাঁড়াইছে। এরপরে গাড়ি বন্ধ কইরা অগোরে নামাইয়া লইয়া গেছে। অগোরে নামাইয়া নিয়া গেছে। আপনেরা যে যাত্রী উডাইয়া দিছেন, হেই যাত্রী নামাইয়া নিয়া গেছে গা। হেই বেডায় আর বেশি কিছু কইতে পারে না। দুইডা সাদা গাড়ি আর লাল গাড়ি, মাইক্রো আইয়া থামাইয়া নিয়া গেছে। গাড়ি থামাইয়া অগো নাম কইয়া অগো ডাইকা নিয়া গেছে।’

‘ঘাট পার হইছে, হেরপরেই, দৌলদিয়া ঘাট নাকি আরিচা ঘাট…। আমি বলতে পারি না। আমি কিছু বলতে পারি না ভাই। আমি কিছু জানি না’, বলেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন সোহাগের স্ত্রী।

‘কইছে, সম্ভবত ঢাকার দিকের তে আইছে’
রূপগঞ্জ থানার পুকুর পাড়ে স্বজনদের মাঝে বসে কাঁদছিলেন নূর হোসেন বাবুর স্ত্রী মুক্তা। তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি বলেন, ‘বাবু, গার্মেন্টস ব্যবসা করে। স্টক ব্যবসা করে। আমরা থাকি রাজারবাগে। ও ওর বড় ভাইয়ের সাথেই ব্যবসা করে। মানে দুঃসম্পর্কের বড় ভাই। ছুটি লইছে, কইয়া যে ভাই, ঈদে যাই নাই কোথাও। দেন ছুটি দেন। ঘুইরা আহি গা। বউ লইয়া তো… ঈদ গেছে বাই… যাই নাই কোনোখানো। ছুটি দিছে।’

‘আমারে কইতাছে, তুমি তোমার মাগো বাসাত্তে ঘুইরা আহোগা। আমি যদি আইতে দেরি হয়, তাইলে তোমার মাগো বাসায় যাওগা। হে আমার মাগো বাসায় যাইব। পরে ফোন দিছি দুপুরে, কই তুমি? কয়, আমি তো আমার এক পরিচিতর লগে দেহা হইছে। হের লগে ঘুরতে যাইতাছি। কই যাইতাছ ঘুরতে? কয়, আমি আইয়া পড়মু। আবার রাইতে ফোন দিছি, যে কই তুমি? কয়, আমি তো যশোর যাইতেছি। যশোর যাইতাছ, আইবা কহন? কয়, আমি সকালে আইয়া পড়মু। তারপরের দিন ফোন দিছি। কয়, আমি রাইতে গাড়িতে উঠমু ১০টায়। তো ১০টা থাইকা ভাই, ওর নম্বর বন্ধ ভাই।’

মুক্তা আরো বলেন, ‘পরে যাদের বাসায় গেছে, তার আব্বা আবার সুপারভাইজাররে ফোন দিছে। ছয়টার দিকে। যে, যারা আপনার গাড়িতে গেছে, অগোর নম্বর তো বন্ধ। সুপারভাইজার কয়, অগোরে তো ধরা লইয়া গেছে। কে ধইরা লইয়া গেছে? কয়, কইতে পারি না, সিভিল পোশাকে আইছে। দুইডা গাড়ি, মাইক্রো গাড়ি লইয়া আইছে। কইছে, সম্ভবত ঢাকার দিকের তে আইছে।’

বাবুর স্ত্রী মুক্তা আরো বলেন, ‘কালকে সকালে মিন্টু রোড, বনানী থানা, সারা ঢাকা খুঁজছি। বুচ্ছেন, আজকে সকালে আমি মুন্সীগঞ্জ যামু। ওই জায়গার অফিসাররা কইছে, এইদিকে তোমরার এই আসামি আহে নাই, তোমরা তাইলে যেই জায়গাত্তে ধরছে, ওই জায়গায় যাও।’

‘আমি লোক পাডাইছি। লোক পাডামু, এমন টাইমে আমরা রেডি হইছি, যামু। তো কার পকেটে নাকি, শিমুলের ওয়াইফের নম্বর পাইছে। যার নাম শিমুল ওর ওয়াইফের নম্বর পাইছে। পাওয়ার পরে কইতাছে যে, আপনেগো লোক তো মাইরা এই জায়গায় হালাইয়া রাখছে। রূপগঞ্জের কথা কইতাছে। দৌড়াদৌড়ি কইরা আইলাম’, যোগ করেন মুক্তা।

পুলিশের বক্তব্য
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘আমি সকাল সাড়ে সাতটা, পৌনে আটটার দিকে সংবাদ পাই যে, পূর্বাচলের এগার নাম্বার ব্রিজের নিচে তিনটি লাশ পড়ে আছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে দ্রুত আমার ওখানকার যে ইমার্জেন্সি অফিসার ছিল শফিউদ্দিন, তাঁকে আমি পাঠাই; পাশাপাশি আমি এবং ইন্সপেক্টর আমরাও যাই। গিয়ে দেখি, তিনটা লাশ পড়ে আছে, তিনজনেরই পরনে প্যান্ট, জিন্সের প্যান্ট, একজনের পরনে গেঞ্জি, একজনের শার্ট, বয়স অনুমান ৩০/৩৫ এ রকম হবে।’

ওসি বলেন, ‘তো আমরা লাশগুলো ইনকোয়েস্ট করে দেখলাম মাথায় এবং বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আছে। একজনের পকেটে কিছু ইয়াবা পাওয়া গেছে, ৬০ পিসের মতো ইয়াবা পাওয়া গেছে একজনের পকেটে। আর আরেকজনের পকেটে একটা মানিব্যাগ পাওয়া গেছে, মানিব্যাগের মধ্যে আমরা কিছু কাগজ পেয়েছি। সে কাগজ থেকে আমরা যতোটুকু সংগ্রহ করতে পেরেছি এখন পর্যন্ত একটা শো-রুমের থেকে সে কিছু জিনিস কেনাকাটা করছে, একটা সেলস রিসিট ছিল, সে রিসিটের থেকে আমরা একটা মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাঁর এক আত্মীয়কে আমরা ফোন দিয়েছি, সেখান থেকে জানতে পেরেছি আমরা যে তার নাম শিমুল, বাড়ি খুলনা, খালিশপুর এই দিকে।’

‘উনি যতোটুকু বলল যে, গত পরশুদিন থেকে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না, শিমুলকে পরশুদিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না; মে বি সে কিছুটা অ্যাডিক্টেড ছিল বা মাদকের সাথে, মাদক ব্যবসা বা মাদক মামলা-টামলা আছে এরকম একটা বিষয় তাঁর এক আত্মীয় আমাদেরকে জানিয়েছে আর কি। তাঁরা ইতোমধ্যে চলে আসছে কাছাকাছি। আমরা হয়তো কিছুক্ষণ পরে তাঁদেরকে, তাঁরা লাশ সনাক্ত করবে, এবং তাঁদের বক্তব্য আমরা জানতে পারব।’

এ ঘটনা কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আসলে বন্দুকযুদ্ধ যদি হত, তো সেটা আমার থানা পুলিশ… কোনোভাবেই এরকম কোনো ঘটনা ঘটে নাই আমার থানা পুলিশের সাথে। অন্য জায়গার কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি আসত সেটা হয়তো বা আমার নলেজে আসত। এখন পর্যন্ত এই ধরনের কোনো কিছু আমার নলেজে নাই।’

ওসি জানান, ‘অন্য দুইজনও সোহাগেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এরকম হবে, তাদেরকেও তাঁরা চেনে, বলছে, তিনজন লোককেই একসাথে তাঁরা পাচ্ছিল না, একজনের নাম সোহাগ, একজনের নাম বাবু।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তো মার্ডারই, কোনো বন্দুকযুদ্ধের সংবাদ যেহেতু আমরা এখন পর্যন্ত পাচ্ছি না, আমরা লাশ যেহেতু পেয়েছি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেটা আমরা ধরে নিচ্ছি প্রাথমিকভাবে মার্ডার। মামলার প্রক্রিয়া চলছে, লাশগুলো আমরা ইনকোয়েস্ট করেছি, ইনকোয়েস্ট করে লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য নারায়ণগঞ্জ প্রেরণ করেছি। লাশের যদি আত্মীয়-স্বজন আসে তাহলে আমরা হস্তান্তর করব।’

ঘটনাস্থল থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্ন করলে ওসি বলেন, ‘না, এরকম কোনো কিছু উদ্ধার হয় নাই।’ এ ঘটনায় কাউকে সন্দেহ বা আটকের ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো আটক বা কোনো সন্দেহ এ রকম কোনো কিছু আমরা করতে পারতেছি না। আগে আমরা লাশগুলো আইডেন্টিফাই করতেছি, লাশগুলো আইডেন্টিফাই হলে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের বক্তব্য নিয়ে পরে আমরা হয়ত পরবর্তী স্টেপে যাব।’ সূত্র: এনটিভি অনলাইন।