ঘুরে দাঁড়াতে পোশাক শিল্পকে এখনি যা করতে হবে

ঢাকা অফিস : ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করতে মানুষে মানুষে মেলামেশা বন্ধ করা ও ভিড় থেকে দুরে থাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তাই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে যে লকডাউন চলছে তাতে যেন রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী।

বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর সেলাই মেশিনও তার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে রয়েছে। কেননা এই দুর্যোগের দিনে পোশাক নয় শুধু জরুরী দৈনন্দিন সামগ্রী ক্রয়ের জন্যই এখন মানুষ অর্থ খরচ করছে। একইসাথে সংক্রমণ এড়াতে বন্ধ রয়েছে নানা পোশাক ব্রান্ডের দোকান। বাতিল হয়েছে হাজার কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এর আগে যে বড় সঙ্কটটি মোকাবেলা করেছিল সেটি ছিল ২০১৩ সালে আজকের এই দিনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধস পরবর্তী সময়। কিন্তু সে সময় যে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যেতে হয়েছে সেটি ছিল শুধু বাংলাদেশের একার। কিন্তু এখন যারা বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের মুল ক্রেতা তারাও রয়েছেন চরম বিপদে, যা এই শিল্পের জন্য আরো ভয়াবহ দুর্দিনের পূর্বাভাস দিচ্ছে। বাংলাদেশ রানা প্লাজা পরবর্তী সংকট কাটিয়েছে কিন্তু এবার সংকট মোকাবেলা কতটা সম্ভব হবে?

ক্রেতাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ ও ক্রয় আদেশ পুনর্বহাল করা
পোশাক কারখানা মালিকদের সমিতি বিজিএমইএর সহ-সভাপতি আরশাদ জামিল দিপু বলছেন, “বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেতারা কেমন আচরণ করে সেটি আগে দেখতে হবে। সাধারণত এরকম দুর্যোগ ও তার পরবর্তী সময়ে মানুষ দরকারি জিনিস কেনে। ফ্যাশন সামগ্রী কেনে না।”

বিজিএমইএ বলছে, বছরের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন মৌসুম চলাকালীন মাঝপথে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্রয় আদেশ বাতিল করেছেন ক্রেতারা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর ডিস্টিংগুইশড ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, “এখনই যে চেষ্টাটা শুরু করতে হবে সেটি হল যার যার ক্রেতার সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখা। নতুন অর্ডারের জন্যেও চেষ্টা এখনি শুরু করতে দরকার।”

অন্যদিকে ব্র্যান্ডগুলোর সাথে দ্রুতই মার্কেটিং কর্মকাণ্ড শুরু জরুরী, বলছিলেন মি. জামিল, “তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং জানিয়ে রাখা যে বাংলাদেশ উৎপাদনে প্রস্তুত।”

একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দার সময় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়।

মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, “মাথায় রাখতে হবে যে এসময় ডিজাইনার ব্র্যান্ড বা দামি পোশাক নয় বরং কম দামি পোশাকই হয়ত মানুষ কিনবে।‍ “বাংলাদেশের শক্তির দিকই হল লো-এন্ডের পোশাক। সেটির দিকে অগ্রসর হলে হয়ত বিক্রিতে সমস্যা কম হবে। যেমন টি-শার্ট, সাধারণ শার্ট ইত্যাদি।”

দেনা পরিশোধ, দেউলিয়া হওয়া ঠেকানো
পোশাক শিল্পে সাধারণত কাঁচামাল আমদানি হয় বাকিতে। মি. জামিল বলছেন, “এটা একটা সাইকেলের মতো। আমরা ১২০ দিনের বাকিতে কাঁচামাল আমদানি করি। আর ক্রেতারাও কিছুদিন হল রপ্তানির পর টাকা দিতে ৯০ থেকে ১২০ দিন লাগিয়ে দেয়। সেই টাকা পেলেই তবে কাঁচামালের বাকি পরিশোধ হয়।”

“যেহেতু একটি উৎপাদন মৌসুমের মাঝখানে সব বন্ধ হয়ে গেছে, এই চক্করে পরে কাঁচামালের অনেক দেনা হয়ে গেছে।” বাংলাদেশ মূলত চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল আমদানি করে।

বিজিএমইএ বলছে, এই মুহূর্তে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার দেনায় আছেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। মৌসুমের মাঝামাঝি থাকার কারণে কাঁচামাল মজুদ রয়েছে প্রচুর কিন্তু উৎপাদন বন্ধ থাকায় সেগুলো জমে আছে।

মি. জামিল বলছেন, “করোনাভাইরাসের কারণে যারা বাংলাদেশ থেকে এর আগে পোশাক নিয়েছেন, আমরা যাদের কাছে টাকা পাই, তাদের অনেকেই দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাতে আমরা তাদের কাছে পাওনাটা পাব কিনা সেরকম প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।”

মুস্তুাফিজুর রহমান বলছেন, বাংলাদেশেও যাতে উদ্যোক্তারা দেউলিয়া না হয়ে যান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলছেন, “এক্ষেত্রে কারখানাগুলোর অর্থের সরবরাহ সচল রাখতে হবে। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছেও সহায়তা চাইতে হবে। তা না হলে অনেক মালিককে কারাখানা বন্ধ করে দিতে হবে।”

বাংলাদেশের সরকার ইতিমধ্যেই ৫ ,০০০ কোটি টাকার অর্থ ঋণ আকারে দেবে বলে ঘোষণা করেছে, যা দেয়া হচ্ছে শুধু শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য। বিজিএমইএ বলছে, শ্রমিকদের বেতন একটি কারখানার খরচের বড়জোর ১৫ শতাংশ। সঙ্কট মোকাবেলায় সহায়তার জন্য বিজিএমইএ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিদেশি দাতা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেছে।

উৎপাদন মৌসুম নষ্ট হতে না দেয়া
বছরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উৎপাদন মৌসুমের একটি চলে এপ্রিল-মে মাসে। এসময় পোশাক তৈরি হয় ক্রেতা দেশগুলোর শীতকালের জন্য। পরবর্তী উৎপাদন মৌসুম শুরু হয় অগাস্ট মাসে। তখন গ্রীষ্মকালীন পোশাক উৎপাদন হয়।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেই কারখানা খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মালিকেরা। কারণ মৌসুম চলে গেলে পণ্য বিক্রি হবে না। শীতের পোশাক যেহেতু আর পরে বিক্রি করা যাবে না সেজন্য এখনই উৎপাদন মৌসুম থাকতে থাকতেই কারখানা চালু করার তাগাদা অনুভব করছেন তারা।

মি. জামিল বলছেন, অন্তত আগামী মাসেও যদি কাজ আংশিক চালু রাখা যায় তাহলে অব্যবহৃত কাঁচামাল দিয়ে এই মৌসুমের উৎপাদন কিছুটা চালানো সম্ভব হবে। তা না হলে তারা পরের উৎপাদন মৌসুম ধরতে পারবেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

লকডাউন উঠে গেলে করণীয়
মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, লকডাউন পরবর্তী সময়ে কারখানাগুলো কীভাবে ধাপে ধাপে খোলা হবে, কীভাবে সেগুলো চলবে, শ্রমিকদের ধীরে কাজে ফিরিয়ে আনা, বাকি থাকা কাজ শেষ করতে ঘণ্টা বাড়াতে হবে কীনা — এসব বিষয় নিয়ে এখনি একটি পরিষ্কার পরিকল্পনা তৈরি করে রাখতে হবে যাতে দ্বিধায় সময় নষ্ট না হয়। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বন্দরে ভয়াবহ জট লেগে রয়েছে। আমদানি করা নানা পণ্যসহ বহু কন্টেইনার পড়ে রয়েছে যা বন্দরের ইয়ার্ডের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি। আরশাদ জামিল দিপু বলছেন, সময়মত সেই জট পরিষ্কার না হলে পরবর্তীতে যে পণ্য রপ্তানি হবে সেগুলোও জমে যাবে।

শিল্পের ক্ষতি মানে শ্রমিকের ক্ষতি
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতে ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। তারা দিন কাটাচ্ছে অনিশ্চয়তায়। তাদের শ্রমে বাংলাদেশের ৮০% রপ্তানি আয়ের কৃতিত্ব পোশাক খাতের। বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হয় এই খাত থেকে। ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ জলি তালুকদার বলছেন, সবচেয়ে প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকদের যাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি না হয়।

তিনি বলছেন, “ইতিমধ্যেই নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও আশুলিয়ার অনেক কারখানার শ্রমিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। আমরা যা শুনতে পাচ্ছি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরো অনেকদিন থাকবে। আরো শ্রমিক যাতে আক্রান্ত না হন সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে হবে।”

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে বহু গার্মেন্টস কারাখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। সর্বশেষ মাসের বেতন পাননি বহু শ্রমিক। জলি তালুকদার বলছেন, “যেসব শ্রমিককে ছাঁটাই ও লে-অফ করা হয়েছে তা বাতিল ঘোষণা করতে হবে। তারা যাতে সুস্থভাবে কাজে ফিরতে পারে তাই এখন তাদের সহায়তা দিতে হবে।”‍ “না খেয়ে তাদের দিন কাটছে। যাদের শ্রমের উপর দাঁড়িয়ে যে খাত চলছে তাদের এখনই খাদ্য সহায়তা দেয়ার জরুরী।”

বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা
চীনের পরে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। তুলা থেকে তৈরি কাঁচামাল ভিত্তিক পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভারত ও পাকিস্তান। আর কৃত্রিম কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ও ক্যাম্বোডিয়া।

চীন করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হওয়ার কারণে ক্রেতারা পণ্য উৎপাদন অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে চান বলে জানাচ্ছেন মি. জামিল। তিনি বলছেন, “বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে চীন থেকে যারা সরে যেতে চান তাদের অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তর করার এখন একটা বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।” এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা বলছেন তিনি। অন্যদিকে, মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, “বিশ্বের যে পরিস্থিতি তাতে ক্ষতি ছাড়া কেউ এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ পাবে না। কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে ক্ষতিটা কম হবে।” সূত্র : বিবিসি বাংলা।