গৃহবধূর সঙ্গে চেয়ারম্যানের অডিও ফাঁস

কুড়িগ্রামে ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দ্য পুওরেস্ট (আইএসপিপি) প্রকল্পে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। গরিব, দুস্থ ও অসহায় গর্ভবতী মা ও শিশুদের বিনামূল্যে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম থাকলেও ঘুষের বিনিময়ে তালিকায় নাম উঠছে। তবে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।

জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দ্য পুওরেস্ট (আইএসপিপি) প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র গর্ভবতী নারী এবং পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের পুষ্টির পরিবর্তে নগদ অর্থ দেয়া হবে। কুড়িগ্রাম জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের লাখ লাখ পরিবার এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন।

প্রতিটি ইউনিয়নে গড়ে এক হাজার ৩৫১ জনকে কার্ড দেয়া হবে। দরিদ্র পরিবারে গর্ভবতী নারী ও শূন্য থেকে ২৪ মাস এবং পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু রয়েছে, তারাই এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী। সুবিধাভোগী গর্ভবতী নারী চার বার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালে ৪ হাজার টাকা এবং টানা তিন বার হলে একটি বোনাস ভাতাও পাবেন। শিশু জন্ম নেয়ার পর ২৪ মাস পর্যন্ত মা ও শিশু এক হাজার ৪০০ টাকা করে পাবেন। প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত শিশুর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিন মাস পর পর ৭০০ টাকা করে ভাতা পাবে। প্রকল্প চলাকালীন সুবিধাভোগীরা কমিউনিটি ক্লিনিকে তাদের উচ্চতা, ওজনসহ নিয়মিত পরীক্ষা করাতে আসলে এ অর্থ পাবেন।

এমন আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা থাকায় জনপ্রতিনিধিরা অর্থের বিনিময়ে উপকারভোগী নির্বাচন করছেন। জেলার সিংহভাগই ইউনিয়নে চলছে তালিকা প্রণয়নের নামে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ। প্রকল্পে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উপদেষ্টা, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সভাপতি করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে টিম গঠন করা হয়।

উপকারভোগীদের তালিকা করার দায়িত্ব পড়ে জনপ্রতিনিধিদের ওপর। ফলে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য জনপ্রতি ৫-১৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নিচ্ছেন। জনপ্রতিনিধির চাহিদা অনুযায়ী যারা টাকা দিচ্ছেন তাদের নাম নেয়া হচ্ছে। আর যারা টাকা দিতে অপারগ তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ফলে দরিদ্র পরিবারগুলো মাসিক ১০০-১৫০ টাকা হারে সুদ বা দাদনের ওপর টাকা নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের দিচ্ছেন।

এরই মধ্যে উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মহু বাদশার বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই ওয়ার্ডের খইমুদ্দিনর নামে এক ব্যক্তি। একই অভিযোগ রয়েছে হাতিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম এবং ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দা পুতুল রাণী, আমিনুল ইসলাম ও মমিনা বেগম বলেন, সিরাজুল মেম্বার এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মর্জিনা বেগম আমার কাছ থেকে ৫ হাজার করে টাকা চাইছেন। টাকা দিলে নাম উঠবে, না হলে নাম উঠবে না বলে দিয়েছেন। টাকা দিতে পারিনি তাই নামও উঠেনি।

কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়ার কাছে থেকে ১০ হাজার টাকা চেয়েছেন রোস্তম মেম্বার। টাকা না দেয়ায় তাকেও ফরম দেয়া হয়নি বলে জানান বাচ্চু মিয়া।

রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়ারচর গ্রামের নুর আলম বলেন, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে মেম্বার খালিদকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি। একই গ্রামের দিনমজুর মমিনুলের স্ত্রী মোহেনা তালিকায় নাম উঠাতে মাসে ১০০ টাকা সুদে পাঁচ হাজার টাকা দাদন নিয়ে মেম্বারকে দিয়েছেন। এমন অনেক ভুক্তভোগী একই ধরনের অভিযোগ করেছেন।

এ বিষয়ে হাতিয়া ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য মর্জিনা বেগম বলেন, টাকা নেয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে যে শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেব।

তবে ঘটনার সত্যতা মিলেছে ঘুষের দর-কষাকষির একটি অডিও ফাঁস হওয়া নিয়ে। রাজারহাট ইউপির চেয়ারম্যান এনামুল হককে এক নারী মোবাইলে বলেন, ‘এনামুল ভাই না, হ্যাঁ। কালকে যে আমাক বললেন, হুম। ওই যে একটা গর্ভবতী আছে, আচ্ছা। তিনি যে টাকা কম দিবার চায়, কত? তিন-চার দিবার চায়, না- দিলেও হবে না। বাচ্চা কয়টা? এইটা প্রথম। প্রথম, ওই একই কথা। ৫ হাজার টাকা নেবেই। কম হবে না। অফিসে পাঁছ নেবেই। এর বেশি যে টা হয় সেটা। যদি দেয় আপনি এক নেবেন। কিন্তু অফিসে পাঁচ নেবে।’

এ বিষয়ে জানতে রাজারহাট ইউপির চেয়ারম্যান এনামুল হককে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমানে চেয়ারম্যান এনামুল ভারতে রয়েছেন।

হাতিয়া ইউপির চেয়ারম্যান এবিএম আবুল হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম। যারা বাদ পড়েছে তারাই মূলত ফরম না পেয়ে এমন মিথ্যে অভিযোগ করেছেন। এরপরও কেউ যদি অর্থ নিয়ে থাকে লিখিত অভিযোগ পেলে ইউএনওকে জানিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রকল্প পরিচালক ও অতিরক্ত সচিব শেখ মো. কাবেদুল ইসলাম বলেন, রংপুর বিভাগের চারটি জেলা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের তিনটি জেলার ৪৩ উপজেলার ৪৪৪টি ইউনিয়নের ছয় লাখ দরিদ্র মানুষ এ সুবিধার আওতায় আসবে। ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আমরা শুনেছি। তবে লিখিত অভিযোগ না থাকায় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি লিখিত অভিযোগ না পেলেও আমারও কানে এসেছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে জনসম্মুখে বসে সবার উপস্থিতিতে তালিকা করা হবে। আমরা শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজটি করতে চাই। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র: জাগো নিউজ।