একটি লাইব্রেরি : ফিরেও তাকায় না কেউ।

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু : বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা এলেই আমরা বই বই বই বলে আনন্দে বিগলিত হই। ভাবটা এমন,যেন একটা বইমেলা করেই সারাদেশে বইয়ের, বইপাঠের সুনামী বইয়ে দেয়া যাবে। ভাবটা এমনই যে পদ্মার চর থেকেও সালামত আলীর মত মানুষেরা সহিসালামতে বইমেলায় গিয়ে দুদশ হাজার টাকার বই কিনে বাড়ি ফিরে আসেন। বিষয়টি এমনও না যে,১৬ কোটি মানুষের ৮ কিংবা ৪ কোটি মানুষ একুশের বইমেলা থেকে বই কিনছেন। অথবা দেশের সমস্ত পাঠকেরাই একুশের বইমেলা থেকে বই কেনেন ।

দেশটা যে শুধু ঢাকা নয় আমরা বুঝেতেই চাই না অথবা বুঝবার মত মাথাই নেই। দেশব্যাপি বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা,বইয়ের পাঠক,ক্রেতা বাড়ানোর জন্য একুশের বই মেলার অবদান নিতান্তই রাজধানী কেন্দ্রিক। রাজধানীর বাইরের বইপ্রেমি মানুষের কাছে একুশের বইমেলার অবদান গৌন। অথচ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা,পাড়া-মহল্লা,গ্রামে গ্রামে গণপাঠাগার কিংবা পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তোলাই ছিল বইকে ভালবাসার উত্তম পথ। সেপথে হাঁটাতো হয়ইনি উপরন্তু যেসব পাঠাগার একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছিল সেসব পাঠাগার,পাবলিক লাইব্রেরি অর্থ,পৃষ্ঠপোষকতা,উদ্যোগের অভাবে মরতে বসেছে।

অামি আমার জেলাশহরের প্রায় শতবর্ষী একটি পাবলিক লাইব্রেরির তিনটি ছবি দিলাম,বাইরের দিকটাই দেখুন,কত দারিদ্র্য,কত অবহেলা। মানিকগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মানিকগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরিটি। বই সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এই লাইব্রেরির একটি গঠনতন্ত্র আছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী লাইব্ররি পরিচালনার জন্য প্রতি ২বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যকরী পরিষদ গঠনের বিধান থাকলেও গত দুই যুগেও কোন নির্বাচন হয়নি। অকার্যকর একটি এডহক কমিটি চলছে বছর তিনেক ধরে। লাইব্রেরিতে নামমাত্র বেতনে আছেন মাত্র একজন লাইব্রেরিয়ান আর একজন পিওন।

চোখের সামনে সবচেয়ে সর্বনাশটি হচ্ছে এই লাইব্রেরিতে প্রবেশ করবার মত ভদ্রোচিত কোন পথ নেই। তিনদিক কোন প্রবেশপথ নেই। পূবদিকের প্রবেশপথটিও অবৈধভাবে দলিল লেখক আর দোকানীদের দখলে। এসবের ফাঁকফোকর গলে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতে হয়। সন্ধ্যা নামলে এপথও হয়ে পড়ে অন্ধকার।

আমরা আমাদের স্কুল-কলেজজীবনে লাইন দিয়ে এই লাইব্রেরিতে গিয়ে বাড়িতে পড়বার জন্য বই এনেছি, লাইব্রেরিতে বসে বসে বই পড়েছি। অথচ এখন সারাদিনে হাতে গোনা ২০/২৫জন পাঠক ছাড়া আর কেউ ওমুখো হয় না। নতুন প্রজন্ম জানেই না জেলা শহরের ঠিক প্রাণকেন্দ্রে এতবড় একটা বইয়ের ভাণ্ডার রয়েছে।

সত্য বলতে কি, টু-পাইস কামানোর সুযোগ নেই আর অলাভজন প্রতিষ্ঠান বলে লাইব্রেরির দিকে ফিরেও তাকায় না রাজনীতিক,আমলা,সমাজপতিরা। ঠিক এমনি করেই হারিয়ে গেছে মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা অসংখ্য পাঠাগার।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা লাইব্রেরিগুলোকে না বাঁচিয়ে,নতুন লাইব্রেরি না গড়ে কেবল বাংলা একাডেমিতে বছরে এক মাসের একটি বইমেলা করে না বাড়বে পাঠক,না বাড়বে ক্রেতা,না বাড়বে অালোকিত মানুষ।

লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক

সব খবর/ মানিকগঞ্জ/ ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/ লিটন