একবার ইউরোপে প্রবেশ করতে পারলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান, মাসে লাখ টাকা উপার্জন সম্ভব- এমন মরীচিকার পেছনে ছুটে ভূমধ্যসাগরে ডুবে প্রাণ দিচ্ছেন বাংলাদেশি তরুণরা। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং জনশক্তি খাত-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে বেকারত্ব, বৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়া এবং ইউরোপের মোহে তরুণরা অনেক সময় ডিঙি নৌকায়ও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন। দালালরা তরুণদের এ স্বপ্নকে পুঁজি করে পাতছেন প্রতারণার ফাঁদ।
গত শুক্রবার লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন ৩৭ বাংলাদেশি তরুণ। উদ্ধার হয়েছেন আরও ১৪ বাংলাদেশি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মৃত ও নিখোঁজ বাংলাদেশির সংখ্যা নিশ্চিত করেনি। মৃত ৩৭ জনের মধ্যে চারজন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের একই পরিবারের সদস্য। সিলেটের ইয়াহিয়া ওভারসিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনপ্রতি আট লাখ টাকায় তারা ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। দালালের সহায়তায় তারা মাস ছয়েক আগে ভারত যান। সেখান থেকে শ্রীলংকা ও দুবাই হয়ে লিবিয়া যান।
সরকার অনুমোদিত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায় নেই ইয়াহিয়া ওভারসিজের নাম। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি বেনজীর আহমেদ এমপি সমকালকে বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের তালিকায় এবং বায়রা সদস্য তালিকায় কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম না থাকার অর্থ তার নিবন্ধন নেই।
নিবন্ধন না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি সিলেটে কী করে এতদিন কার্যক্রম চালিয়েছে তা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে গতকাল থেকে ইয়াহিয়া ওভারসিজের কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক এনাম আহমেদও পলাতক। তার বাড়ি গোলাপগঞ্জে।
বছর চারেক আগে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। কয়েক হাজার বাংলাদেশি তখন নিহত হয়েছিলেন সাগরে। বহু বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছিল থাইল্যান্ডে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়িতে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়া বন্ধ হয়েছে। একইভাবে ইউরোপগামীদেরও ফেরানো সম্ভব বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাবে গত কয়েক বছরে অন্তত কয়েকশ’ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে। তারা অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। ইন্টারনেটে পাওয়া ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয় চেয়েছেন। শুধু ২০১৫ সালেই আশ্রয়ের আবেদন করেন ১৮ হাজার বাংলাদেশি। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকরাও অবৈধ পথে ইউরোপ যাচ্ছেন।
আইওএমের ২০১৭ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ঢোকার চেষ্টা করছে যেসব দেশের নাগরিক, তার শীর্ষ পাঁচে আছে বাংলাদেশ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপের দিকে ছুটছে। কিন্তু বাংলাদেশিরা কেন যাচ্ছেন? এ প্রশ্নে ব্র্যাক মাইগ্রেশনের প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান সমকালকে বলেছেন, এর প্রধান কারণ ইউরোপের মোহ। তরুণদের ধারণা, ইউরোপ যেতে পারলেই লাখ লাখ টাকা উপার্জন করতে পারবেন।
গত বছরের জুনে প্রকাশিত ইউরোপীয় পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, অবৈধভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) প্রবেশ করা নাগরিকের সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০টি দেশের মধ্যে ১৬তম। ২০০৮ সাল থেকে সেখানে অবৈধভাবে গেছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৫৭৫ বাংলাদেশি। ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছেন। ২০১৬ সালে অনুপ্রবেশ করেছেন ১০ হাজার ৩৭৫ জন। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সংখ্যাটি সোয়া থেকে দেড় লাখে দাঁড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইউরোপ থেকে তাদের তাড়াতে ১২ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে ইইউ।
অবৈধভাবে ইউরোপ গিয়ে ধরা পড়ে দেশে ফেরা তরুণদের সহায়তা করে ব্র্যাক মাইগ্রেশন। তাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে শরিফুল ইসলাম হাসান জানান, গত এক দশকে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে। কিন্তু ১৯ লাখ মানুষ ইউরোপ প্রবেশ করতে পেরেছেন। ইউরোপ যেতে মরিয়া তরুণরা মনে করেন তার কিছু হবে না। যে করেই হোক যেতে পারবেন। দালালরাও তাদের আশ্বস্ত করে- কিছু হবে না। এ ভরসাতেই লাখ লাখ টাকা খরচ করে ইউরোপে যাওয়ার ঝুঁকি নেন তারা।
বিদেশে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন কমে যাওয়াকে অবৈধ পথে তরুণদের পা বাড়ানোর একটি কারণ বলে মনে করা হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ আট হাজার কর্মী বিদেশ যান। পরের বছর যান সাত লাখ ৩৪ হাজার। চলতি বছরেরও জনশক্তি রফতানি নিম্নমুখী। সৌদি আরব, ওমান ও কাতার ছাড়া আর কোনো দেশে বড় সংখ্যায় বাংলাদেশি কর্মীরা যেতে পারছেন না। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ প্রায় আট মাস। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার বন্ধ প্রায় অর্ধ যুগ।
জনশক্তি ব্যবসায়ী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ সমকালকে বলেন, বাংলাদেশি তরুণরা লিবিয়া হয়ে ইউরোপের পথ ধরে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যাওয়ার অনুমতি নেই। দালালের সহায়তায় তরুণরা মিসর যায়। সেখান থেকে সীমানা পার হয়ে যায় লিবিয়ায়। আবার ইরাক হয়েও লিবিয়া যাচ্ছে অনেকে। কেউ যাচ্ছে দুবাই হয়ে। সবাই ঢাকা থেকে আকাশপথেই মিসর ও ইরাক যায়। তাই শুরুতেই তাদের আটকানো সম্ভব।
কিরণ বলেন, তরুণদের সাগরপথে মৃত্যুযাত্রার একটি বড় কারণ দেশে বেকারত্ব। দেশের শ্রমিকশ্রেণির কাজ থাকলেও শিক্ষিত তরুণদের জন্য কাজের সুযোগ কম। তারা সামাজিক অবস্থানের কারণে শ্রমিকের কাজ করতে পারে না। তাই দালালের মাধ্যমে বিদেশের পথ ধরে।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বরাবরই ইউরোপের শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার নেই। তার পরও ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইতালিতে সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশি শ্রমিকরা যেতে পারতেন। ২০০৭ সালে দেশটিতে ১০ হাজার ৯৫০ কর্মী যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু গত দুই বছরে একজন কর্মীও যেতে পারেননি। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশিদের জন্য শিক্ষা ভিসার সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে গেছে। এ কারণে অবৈধ অভিবাসন বেড়েছে বলে মনে করছেন জনশক্তি সংশ্নিষ্টরা।
অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টাকারীদের প্রতি তিনজনের একজন ধরা পড়েন অথবা ডুবে মারা যান। বাকি দু’জন প্রবেশ করতে পারেন। তাদের দেখে আরও অনেকে উৎসাহিত হন। তাই উৎসমুখেই ইউরোপ যেতে মরিয়া তরুণদের থামাতে হবে। এ জন্য তাদের জন্য নিরাপদ অভিবাসনের সুযোগ বাড়াতে হবে। তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। যেন বৈধভাবেই বিদেশে কাজের সুযোগ পায়। দেশেও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। কাজ দিতে না পারলে তরুণরা অবৈধ পথে পা বাড়াবেই।
সাগরে মৃত্যুর বিভীষিকা : ভাগ্যান্বেষণে দেশান্তরিত হতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন বহু অভিবাসনপ্রত্যাশী ও শরণার্থী। মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট নামের একটি সংস্থা জানায়, ২০১৪ সালে ৮৯১ জন, ২০১৫ সালে দুই হাজার ৮৮৪ জন, ২০১৬ সালে দুই হাজার ৪৭৪, ২০১৭ সালে দুই হাজার ৭২, ২০১৮ সালে এক হাজার ৫৮৮ এবং ২০১৯ সালে এখন পর্যন্ত ৮৭৮ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী নিহত হয়েছেন।
আইওএম বলেছে, চলতি বছরের প্রথম মাসে পাঁচ হাজার ৯৮৯ অভিবাসনপ্রত্যাশী ও শরণার্থী সাগরপথে ইউরোপে পৌঁছেছেন। এ সময় সলিলসমাধি হয়েছে ২০৮ জনের। শুধু জানুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাপী নিহত ও নিখোঁজ অভিবাসনপ্রত্যাশী ও শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৩০৯ জন। আইওএম জানায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টাকালে ৩০ হাজার ৫১০ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে।
ইউএনএইচসিআর ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে। সংস্থার ভূমধ্যসাগর বিষয়ক বিশেষ দূতে ভিনসেন্ট কোচেটেল বলেন, অন্যথায় এমন ট্র্যাজেডি সামনের দিনগুলোতে আরও দেখতে হবে।
ভূমধ্যসাগর বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংযোগস্থল (ক্রসিং)। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে প্রতি তিনজনে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
আইওএমের হিসাবে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন ৪১০ অভিবাসনপ্রত্যাশী। গত বছর প্রতিদিন এখানে মারা গেছেন ছয় অভিবাসী। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ১ মে পর্যন্ত সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছেন ১৬ হাজার ৮০৬ অভিবাসনপ্রত্যাশী। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৪৩৯ জন।
স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর থেকে লিবিয়া একটি অরাজক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাই ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার প্রধান ট্রানজিট রুট হয়ে উঠেছে লিবিয়া।
তবে অভিবাসনপ্রত্যাশী ও শরণার্থীদের মৃত্যু শুধু ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করেই ঘটছে না। আমেরিকাতেও মারা যাচ্ছে তারা। ভেনিজুয়েলা থেকে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, কিংবা মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সময়ও মৃত্যু ঘটছে তাদের। আমেরিকায় ২০১৯ সালে মৃত্যু হয়েছে ২৪০ অভিবাসনপ্রত্যাশী ও শরণার্থীর। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না। সূত্র: সমকাল।