মো. জসিম জনি : সাংবাদিক জাকির ভাই। লালমোহনের সাংবাদিক অঙ্গনের পথপ্রদর্শক। তিনি শুধু লালমোহনের গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিলেন না। সমগ্র ভোলা এমনকি বরিশালেও তার সুপরিচিতি ছিল। বর্তমানের অনেক প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক এবং প্রবীণ সাংবাদিকদের সহযোগী ছিলেন তিনি। তিনি তৈরি করেছেন নতুন সাংবাদিক।
আজ দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী মরহুম এম. জাকির হোসেনের। ২০০৮ সালে দেশে জরুরি আইন চলছিল। এমন পরিস্থিতিতে খুবই ধৈর্য আর সাহসের সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে ছিলেন তিনি। লালমোহনের আনাচে কানাচে সংবাদের খোঁজে ছুটে চলতেন। কখনো একা, কখনো সঙ্গী সহকর্মীদের নিয়ে। নিয়ে আসতেন মাঠের বাস্তব চিত্র। প্রকাশ করতেন সংবাদপত্রে। এতে কারো পক্ষে যেতো আবারো কারো বিপক্ষে যেতো। বিপক্ষরা নিন্দা করবেন এটা স্বাভাবিক ঘটনা। একজন সাংবাদিক কখনো একসাথে দুই পক্ষকে খুশি করতে পারেন না। যেমনটা পারেন না বিচারক দুইপক্ষকে জেতাতে।
সাংবাদিক হিসেবে এম. জাকির হোসেন এতোটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তার সখ্যতা ছিল সর্বমহল পর্যন্ত। যত অফিসার আসতেন তার সাথে সখ্যতা হতোই। সবাই তাকে ভালো জানতেন। কেউ কেউ প্রেসক্লাবে এসে নিয়মিত বসতেন। আজ দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে লালমোহন প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই সংবাদপ্রেমীকে। সহকর্মীরা আজো বুকে ধারণ করে আছে তাকে।
যার হাতে শেখা তাকে বলে গুরু। আমার সংবাদ লেখা শেখাও সাংবাদিক জাকির ভাইয়ের হাতে। তিনি লিখতেন, আমাকে শেখাতেন। নবীনদের সংবাদ লেখা শেখানোও একটা সখের কাজ। তার আগে প্রয়োজন যাকে শেখানো হবে তাকে যোগ্য হিসেবে বাছাই করা। সবাইকে যেমন শেখানো যায়ও না আবার শিখে কেউ তা যথাযথ ব্যবহারও করে না।
সালটা কত হবে ১৯৯৯ সাল। আমি সেবছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। তারও আগে লেখতাম খাতা কলমে। ছোট ছোট কবিতা, ছড়া এবং ছোট গল্প পাঠাতাম ঢাকার পত্রিকায়, প্রকাশ হলে আনন্দে গা ভাসাতাম। জাকির ভাই লিখতেন দৈনিক দিনকালে। এই দিনকালে আমার একটি কবিতা প্রকাশ হয় সম্ভবত ২০০০ সালে। সেই কবিতাটি নজরে পরে জাকির ভাইয়ের। তাছাড়া সেসময় আমি সাংবাদিক হওয়ার আগেই ‘শিখা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করি। ওই শিখা পত্রিকা এবং তার দিনকালে আমার কবিতা প্রকাশ হলে জাকির ভাইয়ের দৃষ্টি পড়ে আমার উপর। তিনি একদিন খবর দিলেন আমাকে প্রেসক্লাবে দেখা করার জন্য। বর্তমান সদর রোডের লালমোহন ইলেকট্রনিক্স এর দোতলায় টিনের মার্কেটের উপর ভাড়া নেওয়া প্রেসক্লাবে একদিন আমি গেলাম। সেখানে বসা ছিল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সোহেল আজীজ শাহীন। তিনিও আমাকে চিনতেন। তাই আমার লেখালেখিতে আগ্রহ দেখে আমাকে বললেন নিয়মিত প্রেসক্লাবে যেতে। এমনি করে প্রেসক্লাবে আমার পদচারনা।
আস্তে আস্তে আমাকে নিউজ লেখার মধ্যে টেনে নিলেন জাকির ভাই। তখন কম্পিউটার বা লেপটপ ছিল না। ছিল না আমাদের এখানে সংবাদ প্রেরণের আধুনিক ই-মেইল সুবিধা। এমনকি একটি ফ্যাক্সও ছিল না। তাই সংবাদ লিখে বোরহানউদ্দিন বা ভোলা গিয়ে ফ্যাক্স করে দৈনিকের সংবাদ পত্রিকায় পাঠাতে হতো। জাকির ভাই নিজেই ভোলা বা বোরহানউদ্দিন গিয়ে সংবাদ ফ্যাক্স করে নাইটকোচে বাড়ি ফিরতেন। যখন আমাকে পেলেন একাজ শুরু হলো আমার। তিনি সংবাদ লিখতেন কাগজে খসড়া। তা আমি আবার ফ্রেস কাগজে ফাইনাল করে লিখতাম। ওই সংবাদ নিয়ে বিকেল ৪টার মধ্যে বোরহানউদ্দিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতাম। সেখানে নুরুদ্দীন ভাইয়ের একটি ফ্যাক্সের দোকান ছিল। ওই দোকানে গিয়ে ফ্যাক্স করে রাতে বাড়ি ফিরতাম। কখনো কখনো বোরহানউদ্দিনে বিদ্যুৎ না থাকলে চলে যেতাম সরাসরি ভোলা। ভোলা গিয়ে ফ্যাক্স করে রাত ১০টার নাইটকোচে উঠতাম। লালমোহন আসতে সময় লাগতো রাত সাড়ে ১১টা। কখনো কখনো আমরা দুইজনে একসাথেও যেতাম। এভাবেই কাটতো আমার সংবাদ জীবনের প্রথম দিনগুলো। একসময় আমাকে প্রেসক্লাবের একটি অলিখিত পদ ‘বার্তা সম্পাদক’ বানালেন।
২০০১ নির্বাচনের উত্তাল দিনগুলোতে আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম বিভিন্ন ঘটনার। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে যেতাম জাকির ভাইয়ের সাথে। কিন্তু তখন আমি সরাসরি পত্রিকায় কোন সংবাদ পাঠাতাম না। ২০০২ সালে জাকির ভাই আমাকে একটি সাংবাদিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই প্রশিক্ষণটিই আমাকে আজকে পূর্ণাঙ্গ জসিম জনি তে প্রকাশ হতে সহযোগিতা করেছে। ভোলার বর্তমান প্রেসক্লাব সম্পাদক সামস্-উল-আলম মিঠু ভাই ‘ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি)’ তখন ভোলা জেলা প্রতিনিধি। ওই সংস্থা ৭দিন প্রশিক্ষণ দিয়ে তৃণমূল সংবাদ কর্মী তৈরি করবে। প্রতি উপজেলায় একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে মোট দুইজন করে এ সুযোগ পাবে। সাথে থাকবে ৭দিনের প্রশিক্ষণের ভাতাও। জাকির ভাই লালমোহন থেকে আমাকে সিলেক্ট করে দিলেন। ভোলায় থেকে এ প্রশিক্ষণ নিয়ে লেখালেখি শুরু হলো এমএমসির ‘মেঠোবার্তা’ দিয়ে। এ পত্রিকায় লিখলেই পত্রিকা থেকে ভাতা পাঠাতো মনিঅর্ডার করে। ওই বছরই বরিশাল থেকে প্রকাশ হয় ‘আজকের পরিবর্তন’। শুরু হয় আমার নতুন দিনচলা।
আমার পত্রিকায় সংবাদ লেখালেখি চলতে থাকে জাকির ভাইয়ের অনুকরণে। তার লেখা সংবাদই আমি নিয়মিত পত্রিকায় পাঠাতাম। একটি নিউজ ফ্যাক্স করার জন্য যেমনিভাবে ভোলা, বোরহানউদ্দিন দৌড়েছি, আবার তেমনি লালমোহনের মাঠ ঘাট দৌড়ে বেরিয়েছি তার সঙ্গে সংবাদের খোঁজে। তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। একবার উপবৃত্তি দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে সরেজমিন ৮টি ধারাবাহিক রিপোর্ট করলেন। রিপোর্টগুলো তিনি ও আমি যৌথভাবে পত্রিকায় পাঠালাম এবং প্রকাশ হতে শুরু করলো। এ সংবাদে ওই বছর লালমোহন থেকে ভূয়া বৃত্তির টাকাগুলো ফেরত গেল। সেগুলো আর কেউ ভোগ করতে পারেনি। আরেকবার ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লালমোহনে রাতারাতি নতুন মাদ্রাসা গড়ার হিড়িক পড়েছিল। তালগাছে নতুন ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সাইনবোর্ড, কাচারী ঘরে সাইবোর্ড, ক্লাব ঘরে সাইবোর্ড, এমনকি বসত ঘরেও ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রতিষ্ঠান দেখানো হয়। এসবের বিরুদ্ধে তিনি মাঠে নামলেন আমাকে নিয়ে। আমরা মাঠে গিয়ে এমন দৃশ্যগুলো দেখতে পাই। পরে এনিয়ে ধারাবাহিক ১০/১২টি সংবাদ প্রকাশ হলো। জাকির ভাই ও আমার নামে আবারো যৌথভাবে সংবাদগুলো পত্রিকায় আসা শুরু করলো। টনক নড়ে শিক্ষা অফিসের। পরে তারা তদন্ত করে এর মধ্যে অর্ধেক ভূয়া মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়।
বলতে গেলে জাকির ভাইয়ের সাথে আমার যে সময়টুকু একসাথে ছিলাম সে পর্যন্ত আমরা এক সাথেই সংবাদের খোঁজে বের হতাম। যে মানুষটি মৃত্যুর সময়ও আমাকে দেখেছিল হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্সে। ইশারায় আমাকে ডেকেছিল। তার কাছে গেলাম। কিন্তু শেষ কথা বলতে পারলাম না, শেষ ক্ষমাটুকু চেয়ে নিতে পারলাম না। যেটি আমাকে তাড়া করে সবসময়। তার কথা মনে হলে এখনো শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
এম. জাকির হোসেনের মৃত্যু যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি আমাদের জন্য চরম শিক্ষার ঘটনা। এমন করে সবাইকে যেতে হবে পরপারে, কিন্তু সেই মৃত্যু যেন যন্ত্রণাদায়ক না হয় আমাদের চাওয়া তাই। আমরা নিরাপদ সড়ক আর নিরাপদ যানবাহন চাই। অনিরাপদ যানবাহনে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে শরীক হতে চাই না আমরা। কেউ যেন পঙ্গুত্ববরণ করে সারাজীবন না কাঁদে তার নিশ্চয়তা চাই। চালকের বেপরোয়া স্টেয়ারিং ধরা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনে প্রতিদিন ঝরছে তাজা প্রাণ। এসবের কোন প্রতিকার নেই, প্রতিরোধ নেই। যেমনটা চলছে তেমনটা চলেই আসছে। আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। বাঁচতে চাই যেটুক হায়াৎ থাকবে সেটুকু পর্যন্ত সুস্থ সুন্দরভাবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, লালমোহন প্রেসক্লাব।