রোহিঙ্গাদের হত্যা ও দেশ ত্যাগে বাধ্য করতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি কোম্পানি এক কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ দিয়েছিল বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের একটি সংস্থা। বুধবার (৭ আগস্ট) এ খবর জানিয়েছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা। সংবাদ মাধ্যমটি জানায়, সোমবার জেনেভায় মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক সত্যানুসন্ধানী মিশন যে ১১১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের ওই মিশনের প্রতিবেদন আগামী মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে উত্থাপন করা হবে।
এবারের প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোকে চিহ্নিত করে বৈশ্বিকভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের কথা জেনেও ভারত, ইসরায়েলসহ অন্তত সাতটি দেশ ও ১৪টি বিদেশি ফার্মের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের বিষয়টি চিহ্নিত করেছে সত্যানুসন্ধানী মিশন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলোর সহায়তায় মিয়ানমার বাহিনী কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়াই আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে।
মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক সত্যানুসন্ধানী মিশন বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদ ও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবিলম্বে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী পরিচালিত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। সাতটি দেশের অন্তত ১৪টি প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সাল থেকে মিয়ানমারকে যুদ্ধবিমান, সাঁজোয়া যান, যুদ্ধজাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘ নিযুক্ত মিশন তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমার বাহিনীর হাতে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম তুলে দেয়া ১৪টি ফার্মের মধ্যে পাঁচটিই চীনের। এছাড়া রাশিয়া ও ভারতের দুটি করে ফার্ম এবং উত্তর কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইসরায়েল ও ইউক্রেনের একটি করে ফার্ম মিয়ানমার বাহিনীকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর যখন বৈশ্বিক চাপ বাড়ছে তখন ভারত মিয়ানমারকে সাবমেরিন সরবরাহ করতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
জাতিসংঘের স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী মিশন বলেছে, ওই সাতটি দেশ যখন মিয়ানমারকে অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে, তখন মিয়ানমার বাহিনী রাখাইন, কাচিন ও শান রাজ্যে বেসামরিক লোকজনের ওপর ধারাবাহিকভাবে ও ব্যাপক মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটিয়েছে। ২০১৬ সালের ২৫ আগস্টের পর সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
জাতিসংঘের ওই মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান বলেন, ‘এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল ও সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। এ ছাড়া এটি কোনো ধরনের নজরদারি ছাড়াই সামরিক অভিযান চালানোর সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি কমাবে এবং স্বল্প মেয়াদে জবাবদিহিতায় কাজে আসবে।’
যে ৪৫টি কোম্পানি ও সংস্থা মিয়ানমার বাহিনীকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানে অর্থায়ন করেছে তাদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার সিডোটি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখার কথা মাথায় রেখেই তদন্ত হওয়া উচিত।
প্রতিবেদনে কেবিজেড গ্রুপ ও ম্যাক্স মিয়ানমার নামের দুটি কোম্পানির নাম এসেছে। রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তে বেড়া নির্মাণে ওই কম্পানিগুলো অর্থায়ন করেছে।
মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অংশীদারির কাজ করছে এমন অন্তত ১৫টি কোম্পানিকে এবং কিছু না কিছু যোগাযোগ আছে এমন ৪৪টি কোম্পানিকে প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘ মিশন বলেছে, ওই কম্পানিগুলো মিয়ানমার বাহিনীর আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। মিয়ানমার থেকে পণ্য কেনা কম্পানিগুলোর চিন্তা করা উচিত তারা মিয়ানমার বাহিনীর অপকর্মে ভূমিকা রাখছে কি না। সূত্র: ভয়েস অব আমেরিকা