কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিল বাস, মাইক্রোবাস ও ট্রাক। এখান থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের সরাসরি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ট্রানজিট ক্যাম্পে। এ কারণে উখিয়ার বালুখালী থেকে ঘুমধুম সীমান্তের মৈত্রী সেতু সড়কজুড়ে সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যদের ছিল সতর্ক প্রহরা। কিন্তু যাদের জন্য এত প্রস্তুতি, সেই রোহিঙ্গাদের কেউই নিজ দেশে ফেরত যেতে রাজি হননি। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা দ্বিতীয় দফাতেও সফল হলো না।
গতকাল বৃহস্পতিবার ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে অনেক রোহিঙ্গা ফেরত যেতে অনীহার কথা জানান। আবার কেউ কেউ প্রত্যাবাসন এড়াতে আগেই ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান। আর এভাবেই বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আবারও হোঁচট খেল। গত বছরের ১৫ নভেম্বরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। সেবারও রোহিঙ্গাদের আপত্তির মুখে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।
কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সাংবাদিকদের জানান. ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যেতে রাজি না হওয়ায় তাদের ফেরত পাঠানো যায়নি। তিনি জানান, প্রত্যাবাসনের জন্য প্রায় ২০০ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নেওয়া হলেও তাদের একজনও মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হয়নি। ফলে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।
ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থার ঘাটতির কারণেই রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে রাজি হয়নি। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এখনও আশায় বুক বেঁধে আছি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
যেভাবে আটকে গেল প্রত্যাবাসন :গতকাল যাদের ফেরত যাওয়া কথা ছিল, তারা কক্সবাজারের টেকনাফের তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। ক্যাম্প তিনটি হচ্ছে- শালবাগান, নয়াবাপাড় ও লেদা। সকালে শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, আগের দু’দিনের মতো এ দিনও সকাল থেকে দু-একজন করে রোহিঙ্গা আসতে থাকেন সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য। আবার অনেকে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ভয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এখানে আসেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি সাক্ষাৎকার দিতে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন চীনের দুই প্রতিনিধি, মিয়ানমারের একজন, বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব, কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক, টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জসহ ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা। তারা সবাই রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিতে তৈরি করা অস্থায়ী বুথে প্রবেশ করে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কাছে দেশে ফেরার ব্যাপারে মতামত জানতে চান। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, নিরাপত্তা, নাগারিকত্ব, ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেওয়া ও গণহত্যার বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে ফিরে যাবেন না।
পরে সেখান থেকে বেরিয়ে আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করার পরও রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে তাদের মিয়ানমারে পাঠানো শুরু হয়নি। সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গারা বলেছেন, তারা দেশে ফেরত যাবেন না। ফলে কাউকে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ কি-না জানতে চাইলে আবুল কালাম বলেন, এটা ব্যর্থ বলতে পারেন না, ব্যর্থতার কিছু নেই। তিন হাজার ৫৪০ জনের সবার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। আমাদের বাস-ট্রাকও রেডি থাকবে। কেউ যেতে চাইলে পাঠানো হবে। সবার সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যাবাসন ব্যর্থ কিংবা অনিশ্চিত বলা যাবে না।
প্রত্যাবাসন নিয়ে শর্তের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এগুলো মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপার। আমরা শুধু সীমান্ত পার করে দেব।’ তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরতে অনাগ্রহ সাময়িক। আশা করা যায়, ধীরে ধীরে তাদের মনোভাব বদলাবে।
এ সময় চীনের প্রতিনিধি ঝেং তিয়ানঝু বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় মধ্যস্থতার দায়িত্ব তার দেশ নিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, রোহিঙ্গারা কেন নিজ দেশে ফিরতে চায় না? কেন তারা মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের ওপর আস্থা পায় না। এ প্রশ্নগুলোর সমাধান দরকার বলে মন্তব্য করেন চীনের প্রতিনিধি। তবে এখানে উপস্থিত মিয়ানমারের কূটনীতিকের কাছে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এই প্রশ্নগুলো বারবার করলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
শালবাগানে ব্রিফিংয়ের পরপরই টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলন করেন রোহিঙ্গারা। এ সময় নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নাগরিকত্বসহ চারটি শর্ত দেন তারা। রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্ল্যাহ বলেন, ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নাগরিকত্ব দেওয়া, জমিজমা ও ভিটেমাটির দখল এবং সে দেশে ক্যাম্পে থাকা লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে তাদের বাসস্থান ফিরিয়ে দিতে হবে। এই চার শর্ত মানলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যাবেন। শর্ত মানলে তারা আজই সেখানে যাবেন। তারা সবসময়ই যেতে রাজি আছেন। তবে শর্ত না মানলে যাবেন না।
তবু আশাবাদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী : নিজ কার্যালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর জন্য বাংলাদেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ বা আস্থার ঘাটতি আছে। রোহিঙ্গারা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে, তারা রাখাইনে ফেরত গেলে সেখানে নিরাপদে বসবাস কিংবা জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পাবে। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি কিছু সংস্থা এবং কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরতে নিরুৎসাহিতও করেছে। এই চক্রের তৎপরতার কারণেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব কাজ করেছে।
তিনি বলেন, আস্থার ঘাটতি দূর করার জন্য মিয়ানমারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ রোহিঙ্গা সংকটের জন্ম দিয়েছে মিয়ানমার এবং এ সংকটের সমাধানও তাদেরই করতে হবে। আস্থার ঘাটতি দূর করার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা নেতাদের একটা গ্রুপকে রাখাইনে নিয়ে যেতে পারে, সাংবাদিকদের রাখাইনের পরিস্থিতি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করা হোক। এই কমিশন রাখাইন পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের অবহিত করবে। এসব পদক্ষেপ নিলে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের মন থেকে ভীতি দূর হবে এবং আস্থার সংকটও কাটবে। মিয়ানমারের উদ্দেশ্য সৎ হলে তারা অবশ্যই রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরার পদক্ষেপ নেবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা নানা ধরনের অপপ্রচার, নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরতে নিরুৎসাহিত করছে, তাদেরও চিহ্নিত করার কার্যক্রম চলছে। এ বিষয়টিও খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। এ ধরনের তৎপরতার মধ্য দিয়ে বরং রোহিঙ্গাদেরই ক্ষতি করা হচ্ছে। কারণ রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যতের স্বার্থে, তাদের সন্তানদের স্বার্থে অবশ্যই নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে। তারা ফিরে না গেলে তাদের জমি, বাড়িঘর ফিরে পাবে না, অন্যান্য অধিকারও ফিরে পাবে না।
গত বছরের ১৫ নভেম্বরও দিনক্ষণ ঠিক করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়নি। বৃহস্পতিবারও একই ঘটনা ঘটল। তাহলে কি প্রত্যবাসন শুরুর দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এখানে ব্যর্থতার কিছু নেই। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে, আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে মানবিক কারণে। এর আগে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছিল এবং পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার তাদের ফেরত নিয়েছিল। ১৯৯২ সালে প্রায় ২ লাখ ৬৩ হাজার রোহিঙ্গা এসেছিল এবং এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজারই ফেরত গিয়েছিল। এবারও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে এই আস্থার জায়গাটা শুরু থেকেই ছিল, এখনও আছে। আশা করব, মিয়ানমার নিজেদের উদ্যোগেই আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে।
রোহিঙ্গারা ভাসানচরেও যেতে চাচ্ছে না। তাহলে ভাসানচর এত ব্যয়ে প্রস্তুত করা কি অর্থহীন হয়ে যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের ভাসানচরে পাঠানোর বিষয়ে আরও শক্ত ভূমিকা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সবাই মিলে রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো গেলে এবং মিয়ানমার রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরতে উদ্যোগ নিলে অবশ্যই দ্রুততম সময়ের মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। আর এ সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে তা এ অঞ্চলেরই শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য হুমকি হতে পারে, এই সত্যটাও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই- বিশেষজ্ঞ মত : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, একটা স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাব প্ররোচনা দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করছে। এর বিপরীতে রোহিঙ্গদের বোঝাতে হবে। একই সঙ্গে মিয়ানমারকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করে সবার সামনে তা প্রমাণ করতে হবে। বাংলাদেশের আরও জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে। আজ প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি বলে থেমে থাকা যাবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হতেই হবে, এর বিকল্প কিছু নেই।