রাহুল যে কারণে ব্যর্থ

সাইফুল সামিন: উত্তর প্রদেশের আমেথি আসনটি কংগ্রেসের দুর্গ হিসেবেই পরিচিত। অথচ লোকসভা নির্বাচনে সেই আসনেই কিনা হেরেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। আমেথির পাশাপাশি এবার কেরালার ওয়েনাড থেকেও দাঁড়িয়ে ছিলেন রাহুল। বিজেপি বলে আসছিল, আমেথি নিয়ে রাহুল ভয়ে আছেন। তাই ওয়েনাড ধরেছেন।

শেষমেশ বিজেপির কথাই সত্যি হলো! আমেথিতে হেরে মান গেলেও ওয়েনাড থেকে জিতে রাহুলের কিছুটা হলেও ইজ্জত ‘রক্ষা’ পেয়েছে। লোকসভার এই নির্বাচনেও ‘মোদি-ঝড়’ বয়ে গেল। এবার ঝড়ের গতি আরও বেশি। আগের বারের চেয়ে আসনসংখ্যা আরও বেড়েছে বিজেপি ও তার জোট এনডিএর। ফলে বলা যায়, কংগ্রেসসহ বিরোধীদের আশা-ভরসা আপাতত শেষ।

কদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, কংগ্রেসের অবস্থা একদম টাইটানিকের মতো। দলটি প্রতিদিন একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। মোদি ভুল কিছু বলেননি। লোকসভার এই নির্বাচনের পর কংগ্রেসের ছন্নছাড়া অবস্থা আরও স্পষ্ট হলো। বিশেষ করে রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

অবশ্য রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। তাঁকে দিয়ে যে কাজ হবে না, সে কথা তাঁর দলের সভাপতির পদ পাওয়ার বহু আগে থেকেই প্রচলিত রয়েছে। রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধী ৪২ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর রাহুল ৪৯ বছর বয়সে দলের নেতৃত্ব পেয়েছেন। তিনি তিন বারের এমপি। প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় নিজের দলকে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকতে দেখেছেন। এত কিছুর পরও রাহুল সম্পর্কে এখনো বলা হচ্ছে, তাঁর বয়স তো পড়েই আছে। তিনি পরিপক্ব হচ্ছেন। বড় দায়িত্ব নিচ্ছেন। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে তিনি আর কত বড় হবেন, আর কত সময় তাঁর সামনে পড়ে আছে?

যে মুলোটা বাড়ে, তা পত্তনেই বোঝা যায়। রাহুলের বয়স কম—এই যুক্তি প্রায় অচল হতে বসেছে। তিনি জন্মগতভাবে নেতৃত্বের গুণ পেলে আজ হয়তো কংগ্রেসের অবস্থা ভিন্ন হতো। ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের সভাপতি রাহুল। কিন্তু তাঁকে এই পদ পেতে মোটেই কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কংগ্রেস একটা পারিবারিক সম্পত্তি, উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি তার মালিক হয়েছেন মাত্র—এটাই বাস্তবতা। দক্ষতা বা গুণে পদ অর্জনের মতো কিছুই তিনি করেননি বা করতে হয়নি। আবার পদের অধিকারী হয়েও সেই পদে নিজেকে যোগ্য করে তোলার কাজে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

নির্বাচনের ফল আসার পর ভারতের অনলাইনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল দ্য ওয়্যারে নিরাজ মিশ্রের এক নিবন্ধে কংগ্রেস সভাপতির ব্যর্থতার কারণ উঠে এসেছে। নিবন্ধে রাহুলের বড় ব্যর্থতার কারণ হিসেবে কংগ্রেসে নতুন মুখ তুলে না আনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আসলেই তো তাই। দলের কেন্দ্র কিংবা তৃণমূল—সব স্তরের নেতৃত্বেই ঘুরে-ফিরে সেই পুরোনো মুখ। যাঁরা ক্লান্ত, ব্যর্থ। পুরোনো চিন্তাভাবনা নিয়ে এখনো পড়ে আছেন তাঁরা। কংগ্রেসের এই নেতৃত্ব অনগ্রসর, সময় থেকে বহু দূরে। তাঁরা ভোটারদের পালস অনুভব করতে অক্ষম। তাঁরা নিজেরাও স্বপ্ন দেখেন না, অন্যদেরও স্বপ্ন দেখাতে পারেন না।

কথা দিয়ে চিড়ে ভেজে না। রাজনীতি অনেক বদলে গেছে। প্রতি মুহূর্তে তার রং বদলাচ্ছে। কংগ্রেসের নেতাদের দেখে মনে হয়, তারা ১৯৪৭ সালে পড়ে আছে। দলের সভাপতি হওয়ার পর ‘তরুণ’ রাহুলের সামনে একটা বড় সুযোগ ছিল। এই সুযোগ নিজেকে উদ্ভাসিত করার, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, খোলসমুক্ত হওয়ার। কিন্তু তিনি ‘চির-নবিশ’ হয়েই রইলেন। আর চারপাশে ঠাঁই দিলেন পুরোনোদের।

রাহুলের উচিত ছিল পরিবারতন্ত্রের গ্লানি মুছে ফেলতে উদ্যোগী হওয়া। দলে নিজের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তিনি তা পারেননি। তরুণ ও নতুন মুখ দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসার ব্যাপারে কংগ্রেসের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনীহা প্রকট। লোকসভার এই নির্বাচনে নতুনদের টিকিট দিলে কংগ্রেস নিশ্চিতভাবে সুফল পেত বলে মত বিশ্লেষকদের।

রাহুল নিজ থেকে শেখেন না। আবার অন্যদের দেখেও শেখেন না। বিজেপি সময়ের সঙ্গে চলে, দলে ফ্রেশ ব্লাড এনে সফলতা পেয়েছে। অন্যদিকে, নতুনদের জন্য কংগ্রেসের দরজা যেন সব সময়ই বন্ধ। এই দল এগোবে কি করে? তরুণ, উদ্যমী, আধুনিক ও পরিশ্রমী নেতার ধারাবাহিক জোগান না থাকলে কোনো দলের পক্ষে বেশ দূর যাওয়া সম্ভব নয়।

মোদির চেয়ে রাহুল বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু তেজে, মনের জোরে, পরিশ্রমে মোদির ধারেকাছেও নেই রাহুল। খাঁটি রাজনীতিবিদদের নিশ্বাসেও রাজনীতি থাকতে হয়। কিন্তু রাহুলকে দেখে মনে হয়, তিনি শখের বশে রাজনীতিতে এসেছেন। রাজনীতিটা ছেলেখেলা নয়। মায়ের হাতের মোয়াও নয়। কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তাদের মোদি-অমিত শাহদের মতো ক্যারিশমাটিক নেতা দরকার।

শোনা যাচ্ছে, রাহুল দলীয় নেতৃত্বের সামনে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বরাবরের মতো অতীত ঐতিহ্য বজায় রেখে কংগ্রেসের ‘বর্ষীয়ান’ নেতৃত্ব সভাপতির এই ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করবেন তা অনুমান করতে বিরাট বড় পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং উল্টোটা হলে সেটাই হবে বিস্ময়ের। আর না হলে কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীর ভবিষ্যৎ মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকবে।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
saiful.islam@prothomalo.com
সূত্র: প্রথম আলো।