সব খবর ডেস্ক :বর্ষপঞ্জিকার পাতা উল্টে গেল। সমাপ্তি ২০১৭। স্বাগতম ২০১৮। দেয়ালে টাঙানো পুরোনো বর্ষপঞ্জিকাটা ফেলে লাগানো ২০১৮ সালের বর্ষপঞ্জিকা। পাল্টে গেল টেবিল ক্যালেন্ডার, মানিব্যাগে থাকা পকেট ক্যালেন্ডারও। সাথে থাকা স্মার্ট ফোনে নতুন আলোর ঝলকানি, জানাচ্ছে হ্যাপি নিউ ইয়ার-২০১৮।
ফেলে আসা বছরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি; দুইয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের। ঘটনাবহুল বছরের বিভিন্ন স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে রাইজিংবিডি’র ক্রীড়া বিভাগ। পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ তুলে ধরেছেন খেলাধুলা বিভাগের জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসান।
ডাবল সেঞ্চুরিতে বছর শুরু : বছরের শুরুটা সাকিব আল হাসানময়। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ১২ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় দিনটি রাঙিয়ে দেন সাকিব।
বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান। এবং সেই ইনিংসকে নিয়ে যান ২১৭ রানে। তাকে পঞ্চম উইকেট জুটিতে সঙ্গ দেন দলপতি মুশফিকুর রহিম। রেকর্ড ৩৫৯ রানের জুটি গড়েন তারা। যেখানে মুশফিকুর রহিমের অবদান ১৫৯ রান।
ইনিংস ঘোষণায় ম্যাচ হার : সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিমের ম্যারাথন ইনিংসে ৫৯৫ রান সংগ্রহ করে বাংলাদেশ। ২ উইকেট হাতে রেখে আচমকা ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের একার সিদ্ধান্তে ইনিংস ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল বলে গুঞ্জন রয়েছে! পরবর্তীতে ম্যাচও হেরে বসে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৫৬ রানের লিড পেলেও কিউইরা দ্বিতীয় ইনিংসে ঘুরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশকে অলআউট করে দেয় ১৬০ রানে। সহজ টার্গেটে ৭ উইকেট হাতে রেখে জয় পায় নিউজিল্যান্ড।
প্রথমবারের মতো ভারত সফর : দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। ২০০০ সালে টেস্ট অঙ্গনে পা রাখা পরবর্তী ১৬ বছরে ভারতের মাটিতে খেলেনি কোনো টেস্ট ম্যাচ। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরে একটি টেস্ট খেলে বাংলাদেশ।
ঐতিহাসিক টেস্ট পাঁচদিন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য। তবে মুশফিকুর রহিম ১২৭ রানের ইনিংস খেলে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন হায়দরাবাদ। কিন্তু উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধিমান সাহার স্ট্যাম্পিং মিস করে ম্যাচ হারের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে।
এক নজরে টেস্টে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স
শততম টেস্ট জয় : বছরের শুরু থেকে ধারাবাহিক ক্রিকেট খেললেও নিজেদের পক্ষে ফল নিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশ। মার্চে শ্রীলঙ্কা সফরে ধরা দেয় জয় নামক সোনার হরিণের। সেটাও বাংলাদেশের শততম টেস্টে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ শততম টেস্টে জয় পায়। মুশফিকুর রহিমের হাত ধরে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখায় টাইগাররা। অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের পর চতুর্থ দল হিসেবে বাংলাদেশ জায়গা করে নেয় শততম টেস্টে জয়ের তালিকায়। টেস্ট সিরিজ ১-১ ব্যবধানে ড্রয়ের পর ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজও ড্র করে বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য।
সাকিবের কীর্তি : বাংলাদেশের শততম টেস্টে সেঞ্চুরির স্বাদ পান সাকিব আল হাসান। অষ্টম ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব দেশের শততম টেস্টে সেঞ্চুরির স্বাদ পান। এর আগে এ কীর্তি গড়েছিলেন পাকিস্তানের মাজিদ খান, অস্ট্রেলিয়ার ওয়ারেন বার্ডসলি ও চার্লস কেলেওয়ে, নিউজিল্যান্ডের বেভান কংডন ও ব্রায়ান হাসটিংস, দক্ষিণ আফ্রিকার বিলি ওয়েড এবং জিম্বাবুয়ের গ্রায়েম ক্রেমার।
মাহমুদউল্লাহ-মুমিনুল বাদ : শততম টেস্ট জিতলেও মাঠে নামার আগে বিতর্কে জড়ায় বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। অফ ফর্মে থাকা মাহমুদউল্লাহকে দল থেকে বাদ দেয়া হয় কোনো ঘোষণা ছাড়াই। শুধু তাকেই নয় টেস্ট স্পেশালিস্ট খেতাব পাওয়া মুমিনুল হককেও একাদশের বাইরে রাখেন হাথুরুসিংহে।
সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান
সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যান
সেরা টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান
মাশরাফির টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর : শ্রীলঙ্কা সফর পুরোটাই ছিল বিতর্কে ভরা। বিতর্কের শেষটা তীব্র হয় মাশরাফি বিন মুর্তজার ‘জোর-পূর্বক’ টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরে। দ্বিতীয় এবং শেষ টি-টোয়েন্টি চলার সময় কলম্বো স্টেডিয়ামে মাশরাফি ঘোষণা দেন টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরে যাচ্ছেন তিনি।
মাশরাফির জায়গায় সাকিব : মাশরাফি বিন মুর্তজা টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার পর সাকিব আল হাসানকে তার জায়গা নিযুক্ত করে বিসিবি। গত ২২ এপ্রিল বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের নাম ঘোষণা করেন। সে সময় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) খেলতে ভারতে ছিলেন সাকিব।
ত্রিদেশীয় সিরিজ : গত বছরের শেষ প্রান্তে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতে ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ হলেও ত্রিদেশীয় সিরিজে বদলা নেয় বাংলাদেশ।
সিরিজের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে হারায় বাংলাদেশ। পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দাপুটে জয় তুলে নেয় মাশরাফির দল। নিউজিল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়, বাংলাদেশ দুইয়ে থেকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির যাত্রা শুরু করে সেখান থেকে।
সেমিফাইনালে বাংলাদেশ : বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলে মাশরাফি বিন মুর্তজার হাত ধরে। অনেকের মতে এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সাফল্য।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হারে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির যাত্রা শুরু করলেও শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। খাদের কিনারা থেকে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে জিতিয়ে সেমিফাইনালে উঠান। ভাগ্যকেও পাশে পেয়েছিল বাংলাদেশ। বৃষ্টির কারণে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের লড়াই পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়। তাতেই অস্ট্রেলিয়া বাদ, বাংলাদেশ টপ ফোরে।
অস্ট্রেলিয়া বধ : ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডকে সাদা পোশাকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছিল বাংলাদেশ। এক বছর পর ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারায় বাংলাদেশ। নিরাপত্তার অজুহাতে ২০১৫ সালের অক্টোবর বাংলাদেশ সফর স্থগিত করে অস্ট্রেলিয়া।
২৭ আগস্ট ঢাকায় স্টিভেন স্মিথের দলের বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সাকিব আল হাসান অসিদের মাটিতে নামিয়ে আনেন। বল হাতে দশ উইকেট ও ব্যাট হাতে ৮৯ রান করে অস্ট্রেলিয়া বধের কাব্য রচনা করেন সাকিব। কিন্তু পরের ম্যাচে হেরে যাওয়ায় সিরিজ ড্র করে বংলাদেশ।
সেরা টেস্ট বোলার
সেরা ওয়ানডে বোলার
সেরা টি-টোয়েন্টি বোলার
সাকিবের বিশ্রাম ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর : অবসাদ কাটাতে বিসিবির কাছে ছয় মাসের ছুটির আবেদন করেন সাকিব আল হাসান। টেস্ট থেকে ছয় মাসের ছুটি চাওয়া বাঁহাতি অলরাউন্ডারকে দুই টেস্টের সিরিজে বিশ্রাম দিয়েছিল বিসিবি। মূলত দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় সাকিব ছয় মাসের ছুটি চেয়েছিলেন। বিশ্রামে থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বছরের শেষ দিকে টেস্ট সিরিজে ছিলেন না সাকিব।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অসহায় আত্মসমর্পণ : বছরের শুরুর মতো বছরের শেষটা ছিল বিষাদময়। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পুরোই ফ্লপ বাংলাদেশ। টেস্ট ফরম্যাটে সাকিবের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বাংলাদেশ। ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারের পর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজেও হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ। সাকিব দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের অধিনায়কত্বে ফিরলেও তার হাত ধরেও বাংলাদেশের ভাগ্য পাল্টেনি।
হাথুরুসিংহের পদত্যাগ : দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাঝেই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে নিজের পদত্যাগের বিষয়টি জানান চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে এসে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা সারেন সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব পালন করা হাথরুসিহে। তবে যাবার বেলায়ও কিছু বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের দায়িত্ব নেওয়া হাথুরুসিংহে।
ফের টেস্ট অধিনায়ক সাকিব : বছরের শুরুটা হয়েছিল ডাবল সেঞ্চুরিতে। বছরের শেষটাও ডাবল দিয়ে শেষ করেন সাকিব। টি-টোয়েন্টির পর সাকিবের নামের পাশে যুক্ত হয় টেস্ট অধিনায়কত্ব। মুশফিকুর রহিম সাকিবের কাছ থেকে পেয়েছিলেন টেস্ট অধিনায়কত্ব। আবার মুশফিকের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব পান সাকিব। সাকিবের ডেপুটি হিসেবে যুক্ত হন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
নতুন আশা, সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে এসেছে নতুন বছর। গেল বছরটা ব্যাট-বলে দলীয় পারফরম্যান্সে ভালো কাটেনি। এবার ঘরের মাঠে শুরুটা রাঙাতে পারলে বাকিটা পথ হয়ে যাবে মসৃণ। সাকিব-তামিম-মাশরাফি-মুশফিকদের জন্য নতুন বছর বয়ে আনুক শুভ্রতা, মঙ্গল বারতা।