বিপথগামী জওয়ানরা ২০০৯ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যে তাণ্ডব চালিয়েছিলো তা মানুষের মনে এখনো রক্ত ঝরায় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতিক। তিনি বলেন, বলেছেন, দেশবাসী এখনো সেই তাণ্ডবের কথা ভুলতে পারেনি। তিনি ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা দিবসকে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসাবে ঘোষণার দাবি জানান।
ঢাকায় শিশু কল্যাণ মিলনায়তন ১২ দলীয় জোট এর উদ্যোগে আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘পিলখানাহত্যাকাণ্ড দিবস’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় তিনি এসব মন্তব্য করেন। এ সভা সঞ্চালনা করেন এডভোকেট এহসানুল হুদা ও সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার।
সভায় বাংলাদেশ লেবার পার্টি চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিপি চেয়ারম্যান কে.এম আবু তাহের, জমিয়তে ওলামা ইসলামের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন একরামসহ ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য রাখেন।
জেনারেল ইব্রাহিম বলেন, বিদ্রোহের নামে ২০০৯ সালে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সপ্তাহ চলাকালে ২৫ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন বাহিনীর কয়েক শ’ সদস্য। তাদের হাতে পিলখানা সদরদফতরে নিহত হন ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। ২০০৯ সালের এই দিনে রাজধানীর পিলখানায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও ছিলেন। উচ্ছৃঙ্খল কিছু জওয়ান তৎকালীন ডিজির স্ত্রীসহ সামরিক-বেসামরিক আরো ১৭ জন লোককে হত্যা করে।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, পিলখান হত্যাকাণ্ডের পর তদন্ত হয়েছে, এর বিচারকার্য হয়েছে। পিলখানাহত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো প্রশ্ন আছে, এতবড় একটি হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করেই হয়নি। এর পেছনে অবশ্যই বড় ধরনের কোন ষড়যন্ত্র ছিলো। কিন্তু কথা হচ্ছে কেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টি জানতে পারেনি? আবার যদি জানতে পারেন তাহলে কেন এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা হলো না। এই বিষয়গুলো এখনো মানুষের মনে সংশয়, সন্দেহ এবং বেদনা সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি এই সকল প্রশ্নের অবসান হওয়া উচিত এবং সকলকেই নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আসা উচিৎ। কারণ, জবাবদিহিতার অভাবে অনেক বড় ধরনের অঘটন ঘটে যায়। সকল ক্ষেত্রে যেমন শৃংখলা রক্ষা দরকার ঠিক তেমনিভাবে শৃংখলা রক্ষা হচ্ছে কিনা বা কার কি দায়িত্ব তার জবাবদিহিতাও সুনিশ্চিত করতে হবে। যাতে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, সদর দফতর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর কোনও বাহিনীর বিদ্রোহের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বিডিআর ঢাকা সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল মজিবুল হককে ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের চারতলার এক কক্ষে হত্যা করে তার লাশ ফেলে দেয়া হয় নিচে। এভাবে একে একে হত্যা করা হয় সেনাকর্মকর্তাদের। লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে বিডিআর জওয়ানরা। পরে সরকারের সাথে বিদ্রোহীদের আলোচনা শেষে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি অস্ত্র, গুলি ও গ্রেনেড জমাদানের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়। ঘটনার জেরে আধা সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) নাম বদলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়। হত্যা, লুটপাট ও বিদ্রোহের এ ঘটনায় মোট ৫৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে হত্যার এক মামলায় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৪২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২৭৭ জনকে দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৬২ জনকে তিন মাস থেকে ১৯ বছর করে কারাদণ্ড এবং বিএনপির প্রয়াত নেতা নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। অন্যদিকে বিদ্রোহের জন্য দায়ের করা ৫৭ মামলায় বিডিআরের মোট পাঁচ হাজার ৯২৬ জন সদস্যের বিভিন্ন মেয়াদে (চার মাস থেকে সাত বছর) কারাদণ্ড দেয়া হয়।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায় প্রদানকারী তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের পর ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার এ রায়টি প্রকাশ করা হয়।
এনডিপির চেয়ারম্যান কেএম আবু তাহের বলেন, এই ঘটনার পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো বের হয়ে আসেনি। বিচার কিন্তু তখনই হবে যখন পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা যাবে এবং তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে। তিনি বলেন, আমরা কমিশনের কথা বলে এসেছি। এই কমিশন তদন্ত করে জানাবে, ঘটনাটা কেনো ঘটল, কারা ঘটাল এবং সে অনুযায়ী ফৌজদারি আইনে তাদের বিচার হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের তদন্ত প্রতিবেদনের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে লেখা আছে, পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা কিন্তু পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের বের করে আনার দায়িত্বটা সরকারের ওপরই পড়ে।
জমিয়তে ওলামা ইসলাম এর মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন একরাম বলেন, ওই হত্যাকাণ্ডে যারা শহীদ হয়েছেন, তারা সেনাবাহিনীর দক্ষ ও কৃতি অফিসার ছিলেন। অফিসার গুলজার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) মধ্যে জীবন সঞ্চার করেছিলেন; অপরাধীদের দমন করে দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অন্যান্য সেনা কর্মকর্তারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক দক্ষতা প্রর্দশন করেছেন, বিশেষ করে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত সকলেই এইঘটনার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে পর্দার আড়ালের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান।