পানির নিচে চট্টগ্রাম: ভেস্তে যাচ্ছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

‘আহারে জীবন, আহা জীবন, জলে ভাসা পদ্ম যেমন’- ‘ডুব’ সিনেমার এই গানটি যেন বাস্তব হয়ে হাজির হয়েছে চট্টগ্রামে। এখন সামান্য বৃষ্টিতেই পদ্মের মতো জলে ভাসে চট্টলা। বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি মাড়িয়ে কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে নগরীর ৫০ লাখ বাসিন্দাকে। জোয়ারের পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি একাকার হওয়ায় গতকাল সোমবারও জলে ভেসেছে নগরী। অথচ চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে তিনটি সংস্থাকে দিয়ে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। কিন্তু সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয় না থাকা, প্রকল্প কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মনিটর না করা, প্রভাবশালীদের চাপে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে না পারা এবং খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খাল-নালা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করায় ভেস্তে যাচ্ছে সরকারি সব উদ্যোগ। শুধু তাই নয়, জলাবদ্ধতা নিরসনে বরাদ্দকৃত টাকাও যাচ্ছে ফেরত।

চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে। মোট পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরে সর্বশেষ অর্থবছরে তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮৫০ কোটি টাকা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় এ বরাদ্দ থেকে ফেরত গেছে ৪২৫ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরেও বরাদ্দকৃত ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে তারা খরচ করতে পেরেছিল মাত্র দেড়শ’ কোটি টাকা। ফেরত গিয়েছিল বাকি টাকা।

চউকের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়া মেগা প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের জুনে। এ প্রকল্পের অধীনে ৩৬টি খালের মাটি অপসারণ, ছয় হাজার ৫১৬ কাঠা ভূমি অধিগ্রহণ, নতুন ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হবে। ১৭৬ কিলোমিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ৪৮টি পিসি গার্ডার ব্রিজ প্রতিস্থাপন, বন্যার পানি সংরক্ষণে তিনটি জলাধার, ছয়টি আরসিসি কালভার্ট প্রতিস্থাপন, পাঁচটি টাইডাল রেগুলেটর, ১২টি পাম্প হাউস স্থাপন, ৪২টি সিল্টট্রেপ স্থাপন ও ২০০টি ক্রস ড্রেন কালভার্টও নির্মাণ করার কথা। কিন্তু গত এক বছরে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই এ প্রকল্পে। শুধু খাল খননের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের প্রথম বছরের কার্যক্রম। নগরীর ১৩টি খালে এক হাজার ৫৭৬টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছে তারা। এসব স্থাপনা বেদখল করে রেখেছে ১২৩ একর ভূমি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) প্রতিষ্ঠান জরিপ করে এসব অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করলেও প্রভাবশালীদের চাপে এখনও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি চউক। অথচ সামান্য বৃষ্টিতেই কোমরপানিতে ডুবে যাচ্ছে চট্টগ্রাম।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পরিচালক আহম্মদ মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথম বছর খাল খননে মনোনিবেশ করেছি আমরা। চিহ্নিত করেছি অবৈধ স্থাপনা। এখন এসব স্থাপনা উচ্ছেদে কার্যক্রম শুরু করা হবে। নির্মাণ করা হবে স্লইস গেইটও। আশা করছি এ বছর দৃশ্যমান উন্নয়ন হবে প্রকল্পে।’ জলাবদ্ধতার বরাদ্দ ফেরত যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজ করতে না পারায় প্রকল্পের কিছু টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে আবার নতুন করে বরাদ্দ পাব আমরা।’

শুধু চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নয়, চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও। বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প গ্রহণ করেছে তারা এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে। ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননের এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক)। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। অথচ প্রকল্পের কাজ এখনও শুরুই হয়নি। কাজ শুরু করতে গড়িমসি হওয়ায় এ প্রকল্পের ব্যয় এরই মধ্যে বেড়ে গেছে চার গুণ। শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২৬ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামশুদ্দোহা বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণ, অপ্রতুল বরাদ্দসহ নানা জটিলতার কারণে খাল খনন প্রকল্পের কাজে কাঙ্ক্ষিত গতি নেই। তবে আগামী বছর এ প্রকল্পে থাকবে দৃশ্যমান অগ্রগতি।’

এদিকে নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আরও একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। মহানগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিস্কাশন উন্নয়ন শীর্ষক এ প্রকল্পের অধীন কর্ণফুলী নদীতে পড়া ২৩টি, হালদায় তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে পড়া ১৪টি খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণ করা হবে। এসব খাল সুরক্ষিত করতে নির্মাণ করা হবে রিটেইনিং ওয়াল, যার দৈর্ঘ্য হবে দুই দশমিক ৭০ কিলোমিটার। পাম্প হাউসের কাজ নিরবচ্ছিন্ন করতে জেনারেটর ও রেগুলেটর স্থাপন করা হবে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে স্থাপন করা হবে সাতটি জেনারেটর। পাশাপাশি রেগুলেটর স্থাপন করা হবে ২৩টি। অধিগ্রহণ করা হবে ছয় হেক্টর ভূমি। এ প্রকল্পটি এরই মধ্যে একনেকে অনুমোদন হয়েছে। এ প্রকল্পের কাজ শিগগির শুরু হলেও এ বর্ষায় এটি থেকেও কোনো সুফল পাবে না নগরবাসী।

পানির নিচে চট্টগ্রাম : টানা দুই দিনের ভারি বর্ষণে চট্টগ্রাম এখন পানির নিচে। নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাতেই হাঁটু থেকে কোমরপানি জমে আছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আবহাওয়া অফিস চট্টগ্রামে ১৮৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন সড়কে পানি জমে গিয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে যানবাহন চলাচলে। যানজট তৈরি হয়েছে মূল সড়কগুলোতে। জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে অলিগলিতেও। পানি ঢুকে পড়েছে বাসা-দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, কাঁচাবাজারেও। বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। হালিশহর, ওয়াসা, মেহেদিবাগ, প্রবর্তক, অক্সিজেন মোড়, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, পাঁচলাইশ, শুলকবহর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বাকলিয়াসহ নগরীর বড় অংশজুড়ে জলাবদ্ধতা। হালিশহরে সিলভার বেলস, সেটেলমেন্ট স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও কোমরপানিতে তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো স্কুল অনির্ধারিত ছুটি ঘোষণা করেছে।

হাসপাতালে হাঁটুপানি : টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে নগরীর নিম্নাঞ্চলের হাসপাতালেও জমেছে হাঁটুপানি। আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালের নিচতলা হাঁটুপানির নিচে, জরুরি বিভাগও তলিয়ে গেছে পানিতে। চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মানুষকে এ সময় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জলাবদ্ধতার কারণে হালিশহরের মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতাল এবং সাউথ পয়েন্ট হাসপাতালে আসা রোগীদেরও পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। মা ও শিশু হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন ব্যাংক কর্মকর্তা রফিকুল আলমের স্ত্রী। প্রসবজনিত সমস্যা নিয়ে স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন তিনি। রফিকুল আলম বলেন, ‘দিনভর পানিতে থৈ থৈ করেছে মা ও শিশু হাসপাতাল। জরুরি বিভাগে এসেও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে অনেকে। যেসব রোগী হুইলচেয়ার ব্যবহার করে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করেন, চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাদের।’ নিউজ সমকালের।