নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের ব্যাপারে জাতিসংঘকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। এ জন্য জাতিসংঘের সনদের আলোকে ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে বাংলাদেশ। এছাড়া নির্যাতনবিরোধী জাতিসংঘ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বুধবার জেনেভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময় নির্যাতনবিরোধী জাতিসংঘের কমিটির কাছে এ প্রতিশ্রুতি দেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। এতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনার বুধবার ছিল দ্বিতীয় দিন। এদিন মূলত কমিটির করা প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী সপ্তাহে কমিটি সমাপনী বিবৃতি দেবে। বিবৃতিতে দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে একটি পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকার দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন কমিটির চেয়ারম্যান জেনস মডভিজ।
আনিসুল হক পর্যালোচনা সভায় বিচারপতি এস কে সিনহা, আলোকচিত্র সাংবাদিক শহীদুল আলম, দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের নালিস দিয়ে আলোচিত প্রিয়া সাহার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতো সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শ করে সরকার বিশেষ আদালত গঠন করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাহী বিভাগের সাথে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ বেশকিছু প্রকল্পের মাধ্যমে এই নির্দেশনা পালন করছে। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। মামলা জট কমাতে জাতীয় বিচারিক কমিশন গঠন করা হয়েছে। আদালতের অবকাঠামো বাড়ানো হচ্ছে। আইনি সহায়তা সেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে ও জাতির চার নেতাকে কারাগারে হত্যার পর দায়মুক্তি এবং হত্যাকারীদের দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ইতিহাস তুলে ধরেন আনিসুল হক। এ ব্যাপারে বিশ্বের নিরবতার সমালোচনা করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয়।
কমিটির প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানরত অপরাধীদের বিচারে আইনে বাধা নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তি তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ পান। যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনজীবী না দিলেও সরকার তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত বিদেশে অবস্থানরত অপরাধীদের জন্য সরকার আইনজীবী দিয়েছিল।
পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, পুলিশ অস্ত্র ব্যবহার করলে পূর্ণ তদন্তের বিধান রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শেষ পদক্ষেপ হিসাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। অনেক অপরাধী গ্রেফতারের চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয় বলে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। আনিসুল হক বলেন, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেয়ার সময় ম্যাজিট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতে চিহ্ন রয়েছে কিনা তা যাচাই করতে পারেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি না দিলে আইনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। সরকারের একজন মন্ত্রীর মেয়ের জামাই হওয়া সত্বেও নারায়ণগঞ্জে এইট মার্ডারের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ছাড় দেয়া হয়নি।
রিমান্ড সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কোনো ঘটনা তদন্তের জন্য পুলিশকে ক্ষমতা দিতে হয়। অন্যথায় সত্য উঠে আসে না। রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ আনলে ম্যাজিট্রেট মেডিক্যাল পরীক্ষার অনুমতি দিতে বাধ্য। তদন্তের জন্য রিমান্ড আবশ্যক। তবে এর অপব্যবহার যাতে না হয় সে জন্য সরকার সতর্ক রয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচারপূর্ব আটকের সময়সীমা বাংলাদেশের আইনে নির্ধারিত রয়েছে। অভিযোগ দায়েরের ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার বিধান নির্যাতনবিরোধী আইনে রয়েছে। তবে মামলা জটের কারণে অনেক সময় এই সময়সীমা অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। বিচার বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে বিচারিক অডিট চালু করেছে বাংলাদেশ।
মন্ত্রী জানান, কারাগারের ধারণক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিদ্যামান কারাগার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধারণক্ষমতা ১৬ হাজার বাড়ানো হচ্ছে। নতুন নয়টি কারাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে আরো বড় পরিসরে গাজীপুরে স্থানান্তর করা হয়েছে। কারাগারে চিকিৎসা এবং নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল।
বিচারপতি এস কে সিনহা সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এস কে সিনহাকে দুর্নীতির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তারপরও শেখ হাসিনা সরকার সিনিয়র হিসাবে সিনহাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি ব্যক্তিগত লাভের জন্য অনেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষার্থে তার চাকরীর মেয়াদ থাকা পর্যন্ত সরকার অনিয়মের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা সীমা ছাড়িয়ে যায়।
সিনহার দুর্নীতির ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, রাষ্ট্রপতি এসব দুর্নীতির নথিপত্র আপিল বিভাগের বিচারকদের দিয়েছিলেন। সিনহা এ সব দুর্নীতির যথাযথ উত্তর দিতে না পারায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা তার সাথে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটেই সিনহা পদত্যাগ করেন।
প্রিয়া সাহা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় সরকার সচেষ্ট। সম্প্রতি ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে প্রিয়া সাহা ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন। এ সময় একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তিনি সাক্ষাত করেন। প্রিয়া সাহা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু নিখোঁজ হয়ে গেছে। গবেষক আবুল বারাকাতের তথ্যের ভিত্তিতে প্রিয়া সাহা এ অভিযোগ করেন বলে পরে জানান। কিন্তু এ ধরনের কোনো তথ্যের কথা খোদ আবুল বারাকাত অস্বীকার করেন।
আনিসুল হক বলেন, সরকার প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। অনেকেই তা বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করলেও আদালত তা নাকচ করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সংযত আচরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পিরোজপুরে প্রিয়া সাহার জমি আদৌ কেড়ে নেয়া হয়েছে কিনা – তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
বিশৃঙ্খলায় উস্কানি দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে শহীদুল আলমে গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে জানান আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আদালতের নির্দেশনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা করে। বর্তমানে তিনি মুক্ত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যকর ভূমিকার জন্য সরকার সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানান আনিসুল হক।