চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশার মৌসুম শুরু হয়ে গেলেও তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। মাঝেমধ্যে দু-একটি আলোচনা সভা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি ছাড়া আরও যেসব প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন, অনেকটাই ঘাটতি রয়ে গেছে তাতে। ফলে ইতিমধ্যে মশার দৌরাত্ম্য বেড়েছে রাজধানীতে। আগামীতে অবস্থার আরও অবনতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন সমকালকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। সেই জরিপের ওপর ভর করে মশকনিধনের কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে মশার বিস্তার রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা। বিশেষ করে এডিস মশার ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বেশি প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকটি এলাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। আগামীতে পরিকল্পনা আছে প্রত্যেকটি ওয়ার্ড, আঞ্চলিক কার্যালয় ও নগরভবনের প্রধান কার্যালয় থেকে র্যালি বের করার। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে। তখন মশকনিধন কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।
জানা গেছে, প্রতি বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করে মশকনিধনে। এই বিপুল অর্থে মশার ওষুধ কেনা হলেও রাজধানীতে মশার উপদ্রব কমে না। সারা বছরই মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ থাকেন নগরবাসী। এ নিয়ে অভিযোগেরও শেষ নেই। মশার ওষুধ কেনা ও সঠিক ব্যবহার নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে চলছে নানা লুকোচুরি। গত বছর এডিস মশার কামড়ে নগরবাসী ভয়াবহ চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হওয়া শুরু করলে বিষয়টি আবারও সামনে চলে আসে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালালেও মশকনিধন কার্যক্রমে জোর দেখা যায় না তত। মশকনিধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ফগারম্যানদের দেখাই পাওয়া যায় না। যেখানে প্রতিদিনই ওষুধ স্প্রে করা প্রয়োজন, সেখানে ১০-১৫ দিন পরপর ওষুধ স্প্রে করেন তারা। ফলে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান না নগরবাসী।
ওষুধেই ভেজাল : বরাবরই মশকনিধনের ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। ওষুধ কেনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে মানহীন ওষুধ গ্রহণ করতেন। ওই ওষুধ মশা থোড়াই কেয়ার করত। কয়েক বছর আগে হাতেনাতে ধরা পড়ে বিষয়টি। জনৈক ঠিকাদার মিজানুর রহমান খান ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় ৫০০ ড্রাম অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধ সরবরাহ করেন। সিটি করপোরেশনও গ্রহণ করে সেটা। মাঠপর্যায়ে ছিটালে দেখা যায় মশার কোনো বিকার নেই। পরবর্তীতে নগরভবনে আবার পরীক্ষা করা হয়। তখনও দেখা যায় ছিটানোর পরও দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে মশারা। এরপর ল্যাবরেটরিতে নতুন করে পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায় ড্রামগুলোতে কোনো ওষুধের অস্তিত্ব নেই। কেবলই পানি। এতে জনমনে দীর্ঘদিনের দানা বাঁধা বিশ্বাস দৃঢ় হয় আরও। তবে দুই সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে দরপত্রের মাধ্যমে ওষুধ সংগ্রহ করা হয়। খামারবাড়ির প্লান্টেশন উইং, গাজীপুরের এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও মহাখালীর আইইডিসিআর থেকে পরীক্ষা করা হয় সেই ওষুধ। তিনটি পরীক্ষা রিপোর্টে ওষুধের মান ঠিক থাকলে ওষুধ গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন।
এ প্রসঙ্গে দুই সিটি করপোরেশনেরই দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধে পানি মেশানোর কোনো সুযোগ নেই। পানি মেশালে কখনোই ধোঁয়া হবে না। আর একজন ফগারম্যানকে প্রতিদিন ৩০ মিলিলিটার লার্ভিসাইড ওষুধ দেওয়া হয়, যার দাম ৪৫ টাকা। প্রতি ৬ মিলিলিটার ওষুধে ১০ লিটার পানি মিশিয়ে সেটা ব্যবহার করতে হয়। এই ওষুধ বাইরে বিক্রি করতে গেলে কেউ কেনে না। আর কিনলেও ৩০ টাকার ওষুধ ১০ টাকায় বিক্রি করতে পারে। ১০ টাকার জন্য কোনো ফগারম্যান হয়তো এ রকম করবেন না।
প্রয়োজন প্রতিদিন, ছিটানো হয় মাসে দু’দিন : এডিস মশার মৌসুম মে, জুন ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। এ সময়ে মশার প্রকোপ বেশি থাকে। এ সময়ে বেশি পরিমাণে ওষুধ ছিটানো প্রয়োজন। নগরবাসীর অভিযোগ, সপ্তাহে দু’দিন মশার ওষুধ স্প্রে করার কথা থাকলেও কখনও কখনও এক মাসেও ফগারম্যানদের দেখা পাওয়া যায় না। আর সপ্তাহে দু’দিন স্প্রে করলে মশা নিয়ন্ত্রণে আসার কথা নয়। কারণ ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লার ভেতরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র প্রচণ্ড হতাশাজনক। প্রধান সড়ক ছাড়া অলিগলি প্রায় সব এলাকাই মশার প্রজননের উৎকৃষ্ট স্থল। এ ছাড়া আছে নোংরা নালা-ডোবা, ঝিল, জলাশয়। এ রকম শহরে সপ্তাহে এক-দু’দিন ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব না। আনিসুল হক ডিএনসিসির মেয়র থাকাকালে কাউন্সিলররা মেয়রের কাছে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলে ফগারম্যানদের পরিচালনা ও মশার ওষুধ স্প্রে করার দায়িত্ব কাউন্সিলরদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আগের নিয়মেই মশকনিধন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নগরবাসীর আরও অভিযোগ, যে ওষুধ স্প্রে করা হয়, তা থেকে কেবলই কেরোসিনের গন্ধ আসে। এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘করোসিনের গন্ধ পাওয়া অমূলক নয়। কারণ অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধে ৯৯ দশমিক ৪ শতাংশই থাকে কেরোসিন। আর দশমিক ৬ শতাংশ থাকে ওষুধ। সেখানে পানি মেশালে মেশিন চালু হবে না। অকটেন, পেট্রোল বা ডিজেল মেশালে মেশিন চলতে পারে। কিন্তু সেগুলোর প্রত্যেকটিরই দাম কেরোসিনের চেয়ে অনেক বেশি।’ তিনি জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচজন করে ফগারম্যান দেওয়া হয়েছে। তারা সপ্তাহে দু’দিন ওষুধ স্প্রে করতে না পারলেও ১০ দিনে দু’দিন স্প্রে করতে পারে।
কাজে ফাঁকি দেন ফগারম্যানরা :জানা গেছে, ওষুধ ছিটানোর দায়িত্ব পালনকারীরা প্রতিদিন মাত্র ৮০ টাকা মজুরি পান। এই স্বল্প মজুরিতে কোনো রকম কিছু সময় কাজ করেই বাসায় চলে যান তারা। ফলে ওই অল্পস্বল্প স্প্রে কোনো কাজে আসে না। প্রতিটি ওয়ার্ডে জনবলও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিটি ওয়ার্ডে ২০ থেকে ৫০টা ফগার মেশিন ও ২৫ থেকে ৬০ জন ফগারম্যান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু তা নেই। এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে পাঁচটি মেশিন ও সাতজন লোক আছে। অথচ প্রয়োজন অন্তত ১৫টি মেশিন ও ২০ জন লোক। কিছু কিছু ওয়ার্ডের আয়তন আছে এর দ্বিগুণ। সেখানে দ্বিগুণ মেশিন ও জনবল প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেটা করতে পারছে না। দুই সিটি করপোরেশনে নতুন ৩৬টি ওয়ার্ডের অবস্থা আরও করুণ।
ডিএসসিসি জানায়, বর্তমানে মশার দৌরাত্ম্য বেশি না হলেও মশকনিধন কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই বিশেষ অভিযান শুরু হবে। ওষুধেরও কোনো ঘাটতি নেই। নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মশাও। সূত্র: সমকাল।