ডেঙ্গু: এবার বিজ্ঞানীরা হাত বাড়ান

এজাজ মামুন : ছোটবেলায় অনেক কষ্টে-সৃষ্টে মশারি গোজার পরও মশার কামড় থেকে প্রায়ই মুক্তি পেতাম না। আমার বড় চাচা আমাদের একদিন এর এক কারণ বেশ মজা করে বললেন যে, মশারা দল বেঁধে থাকে। দুটি মশা মশারির সুতো টেনে ধরে আর একটি ভেতরে প্রবেশ করে। এভাবেই পালাক্রমে তারা আমাদের সুরক্ষা বরবাদ করে দিয়ে তাদের রসনা পূর্ণ করে। বড় হয়ে বুঝেছি, আমাদের অসতর্কতা মশা বৃদ্ধি ও এদের দ্বারা রোগ ছড়ানোর মূল কারণ। মশা হলো প্রাণঘাতী জীবগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিবছর ৭০০ মিলিয়ন মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় আর এক মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহ থেকে এডিস মশার বংশবিস্তার ও ডেঙ্গুর প্রকোপ এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আহাজারি করছে। হাসপাতালগুলো এখন নতুন ডেঙ্গু রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ থাকতে পারে। বিভিন্ন কারণে ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়াসহ এ জাতীয় রোগ ছড়ানো এডিস প্রজাতির মশাগুলো খুব মারাত্মক। তার একটি বড় কারণ হলো এসব রোগ সংক্রমণের ভাইরাস বহনকারী মশা যে ডিম পাড়ে, তা–ও এসব রোগের ভাইরাস বহন করে। আর এ জন্য এডিস মশা সব সময় ডেঙ্গু রোগীর রক্ত চুষে ডেঙ্গুর ভাইরাস বহন করার প্রয়োজন পড়ে না। হয়তো এ জন্যই ডেঙ্গু রোগের বিস্তার খুব সহজে হয়।

ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত এ রোগের কোনো ওষুধও নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রোগ এত মারাত্মক যে গর্ভবতী মা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অনাগত সন্তানও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এডিস মশা দ্বারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটছে। ডেঙ্গুতে প্রতিবছরই ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এটা এখন স্পস্ট যে এডিস মশা নিধনই ডেঙ্গু এবং এ জাতীয় রোগের মুক্তির একমাত্র পথ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞানীরা এডিস মশা নিধনের জন্য কাজ করছেন এবং বেশ কৃতকার্যও হয়েছেন।

বাংলাদেশে শুধু এ বছর নয়, প্রায় অনেক বছর ধরে মূলত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের আবির্ভাব। তারপর মশা নিধন নিয়ে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটছে তা সত্যিই হতাশাজনক। এবার সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ যে অবস্থায় পৌঁছেছে তাকে মহামারি হিসেবে গণ্য না করার এখন আর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এডিস মশা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য যেমন প্রতিটি নাগরিকের পরিচ্ছন্নতাসহ অনেক কর্তব্য রয়েছে, তেমনি সিটি করপোরেশনেরও রয়েছে ব্যাপক দায়িত্ব। সব নাগরিকই একমত যে মূলত ঢাকার মতো একটি অপরিকল্পিত শহরে পরিকল্পনাহীন মশা নিধন কর্মকাণ্ডের যে ফলাফল নাগরিকেরা ভোগ করছে, তার দায় থেকে সিটি করপোরেশন দুটি মুক্তি পেতে পারে না। সবচে হতাশার বিষয় হলো, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ মশা নিধনের জন্য যে কেমিক্যাল বা কীটনাশক ব্যবহার করছে, তার কার্যকারিতা বা ইফিকেসি সম্বন্ধে নিজেরাই সন্দিহান। আর মশা নিধনের জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার ছাড়াও যে অন্য ব্যবস্থাপনা প্রণালি রয়েছে, তা–ও খতিয়ে দেখছে না।

এখন কেমিক্যাল বা কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য সফল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দেশে মশার বিস্তার রোধে সফলতা পেয়েছেন এবং সফলভাবে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন। কেমিক্যাল ব্যবহারের জটিলতা, মশার প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি ও পরিবেশগত বিপর্যয়কে বিবেচনা করে প্রতীয়মান হয় যে এই প্রযুক্তিগুলো অনেকটা টেকসই। যেমন চীনা বিজ্ঞানীরা উল্বাকিয়া ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত ও নির্বীজিত (sterilized) ও সংগতিরহিত (incompitable) পতঙ্গ প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুটি দ্বীপ শহরের এডিস এল্বোপিক্টাস প্রজাতির মশার বিস্তার দ্বিতীয় বছরে ৯৪ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরাও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের একটি অঞ্চলের এডিস এজিপ্টি প্রজাতির মশা ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনার সফলতা দেখিয়েছেন। জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) ও জিন এডিটিং টেকনোলজি ব্যবহার করে ‘জিন ড্রাইভ’ আর ‘পপুলেশন সাপ্রেশন’–এর মাধ্যমে মশার বংশ ও রোগ বিস্তার রোধ করতেও সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তা ছাড়া ট্র্যাপ এবং ট্র্যাপিং পদ্ধতিও অনেক অঞ্চলে ব্যবহার করে সফলভাবে মশা নিধন সম্ভব হয়েছে।

বায়ো-কন্ট্রোল এজেন্ট, লার্ভিভোরাস মাছ, প্যারাসাইট প্রভৃতি মশা নিধনে কার্যকার হতে পারে। তাই বাংলাদেশে মশা নিয়ে এই সংকটে বিজ্ঞানীদের সঠিক ও সমন্বিত মশা দমনের প্রযুক্তি শনাক্তের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সারা বিশ্বে কেমিক্যাল ব্যবহার ছাড়াও যে পদ্ধতি ও প্রযুক্তি এডিস মশা দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই প্রযুক্তিগুলো বাংলাদেশের সংকট মোকাবিলার জন্য সঠিক করে তোলার মতো অজস্র কীটতত্ত্ববিদ, মলিকুলার ও জীন প্রযুক্তিবিদ বাংলাদেশে রয়েছেন। তা ছাড়া দেশের অনেক গবেষণাগার এই প্রযুক্তি তৈরির জন্য উপযোগী। শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও আর্থিক সহায়তা।

প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে মশা দমনের যে ব্যর্থতার উপখ্যান রচিত হয়েছে, তা নাগরিকদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান, সরকারের পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও আর্থিক সহায়তা আর দেশের বিজ্ঞানীদের একাগ্রতায় সফলতার উপখ্যান করে গড়ে তোলা সম্ভব, এটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়। আমরা আশাবাদ ব্যক্ত করছি, দেশের বিজ্ঞানীরা, সিটি করপোরেশন ও সরকার এই ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও এ জাতীয় মশাবাহিত রোগ থেকে পরিত্রাণ আমাদের পেতেই হবে। সূত্র: প্রথম আলো।
লেখক, প্রবাসী, বিজ্ঞানী