কেন এই ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যা বলছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী

ঢাকা অফিস : আচমকা এক বিস্ফোরণে ধ্বংসলীলায় পরিণত হয় মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকা। গত কয়েক দশকে ঢাকায় এতো বড় বিস্ফোরণের ঘটনা আগে ঘটেনি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে। একটি ভবনের বিস্ফোরণে আশপাশের আরও ৯টি ভবন ও সড়কের ৩টি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেন এবং কীভাবে এত বড় বিস্ফোরণ ঘটলো তা নিয়ে মাঠে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য সংস্থাগুলো। তারা প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় বাসিন্দা ও ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের তথ্যগুলো তারা পর্যালোচনা করছেন। সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে কাঁচ, বৈদ্যুতিক তার ও দেয়ালের খসে যাওয়া পলেস্তারাসহ নানা আলামত সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়াও ডিএমপির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা সেখান থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে।

তদন্ত শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ সদস্যের কমিটি।
এ ঘটনায় তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও ড্রেনের কাজে যুক্ত ওয়াসার কোনো গাফিলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভবনটি অতি পুরনো। ১৯৭২ সালে ওই তিন তলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এরমধ্যে সেখানে আর কোনো নির্মাণ কাজ করা হয়নি। ভবনের দেয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছিল। তবুও ওই ভবনে প্রায় ১০টি প্রতিষ্ঠান ভাড়া নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল। এ ছাড়াও বাড়িটির কোলঘেঁষে রয়েছে দুইটি বিদ্যুতের খুঁটি। তারগুলো দেয়ালের সঙ্গে লাগানো। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভেতরে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। শুধু গ্যাস থেকে এমন বিস্ফোরণ হতে পারে তা তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে আলামত ঘেঁটে অনেকটা অনুমান করা গেছে এটি কোনো নাশকতার ঘটনা নয়।

গত রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকায় ৭৯ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের পুরনো ৩ তলা একটি ভবনে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭ জন নিহত ও প্রায় শতাধিক আহত হয়েছে। এরমধ্যে ৬৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গতকাল সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। ভবনের ভেতরের ভেঙে পড়া জিনিসগুলো সরাচ্ছিল ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। সকাল থেকে ওই ভবনটি দেখতে ভিড় জমায় উৎসুক জনতা। তাদের সেখান থেকে সরাতে বেগ পেতে হচ্ছিল পুলিশকে। ভবনের নিচতলায় একটি খাবারের দোকান ও একটি মাংস বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দোকান ছিল, যার অস্তিত্ব বোঝার কোনো উপায় নেই। দুইটি আলাদা আলাদা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের কারণে মিশে গেছে। সড়কে থাকা ৩টি বাসে ছিল রক্তের দাগ। উপরে ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রির একটি শো-রুম ছিল সেটির বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে। ভবনটির পিলার ভেঙে উপরের তলা ধসে পড়েছে। ওই বিস্ফোরণে যে আশপাশের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পরিষ্কার করতে কাজ করছিলেন স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, ওই ভবনে গ্যাসের লিকেজ আছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ নিচতলায় একাধিক গ্যাসের লাইন ছিল। পুরো তিনতলা ভবনে গ্যাসের সংযোগ আছে। সূত্র জানায়, এ ছাড়াও নিচের দুই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার হতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, গ্যাস দীর্ঘদিন ধরে জমা থাকার পর গ্যাস লাইট বা দিয়াশলাই এর আগুনের সংস্পর্শ পাওয়ার পর বিকট আকারে বিস্ফোরিত হয়েছে।

সূত্র জানায়, তারা আরেকটি বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করছেন। সেটি হলো, ভবনের সামনে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ড্রেন নির্মাণের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করছেন। সেই স্থানে বড় একটি গ্যাসের লাইন চলে গেছে। সেখানে গ্যাসের লাইনে কোনো লিকেজ আছে কিনা বা ওই বিস্ফোরণে শক্তিশালী মাত্রা দিয়েছে কিনা তা তারা খতিয়ে দেখছেন।

গতকাল সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ একাধিক সেবা ধর্মী প্রতিষ্ঠান ওই বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তাদের সবার মুখে ছিল একটাই কথা, মিথেন গ্যাস জমা হয়ে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে তারা তা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি।

গতকাল সকাল ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান, আমরা গ্যাস ডিটেক্টর নিয়ে গিয়েছিলাম। এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের আলামত আছে কিনা তা জানার চেষ্টা করেছি-এটা হাইড্রো কার্বন ডিটেক্ট করে। এখানে হাইড্রো কার্বনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে বিস্ফোরণে উৎস সম্পর্কে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলার সুযোগ নেই।

তিনি আরও জানান, একটার কারণে আরেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইলেকট্রিক সার্কিটের কারণে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে আগুন লাগলে আশপাশে সিলিন্ডার বা ন্যাচারাল গ্যাসের লাইন থাকুক তাহলে এসবও এর আওতায় চলে আসে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঢুকে কোথাও মুভ করবো, এমন সুযোগ ছিল না। ছাদও ভাঙা। দুই স্থানে গ্যাস ডিটেক্টর নিয়ে কাজ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, মগবাজারের ঘটনায় বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে, সেখানেও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রতিনিধি থাকবেন।

এদিকে, গতকাল দুপুরে মগবাজারে বিস্ফোরণের উৎসস্থল তিনতলা ভবনটির ক্ষতির মাত্রা যাচাই করতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে রাজউকের একটি দল।

এ বিষয়ে রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) প্রকৌশলী মো. মোবারক হোসেন জানান, আমরা ভবনটি দেখছি। একটি দল কাজ করছে। তারা প্রতিবেদন দেয়ার পর সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিস্ফোরণের পর ভবনটি আর ব্যবহার উপযোগী আছে কিনা সন্দেহ আছে। আমরা যা দেখেছি সেটা নিয়ে প্রতিবেদন দেবো। তবে ভবন ব্যবহার উপযোগী আছে কিনা না সেটা নির্ভর করবে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ মতামতের ওপর। তবে গতকাল বিকাল পর্যন্ত সেখানে কোনো বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল আসেনি বলে জানা গেছে।

এ ছাড়াও বিস্ফোরণের কারণ, অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। গত রোববার রাতে গঠিত ওই তদন্ত কমিটি গতকাল সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে বলে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন) শ্রী দেবাশীষ বর্ধন। তিনি জানান, ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। তারা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে ওই প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে।

অপরদিকে গতকাল দুপুরে সরজমিন ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের আইজি ড. মো. বেনজীর আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের জানান, বিস্ফোরণের সবগুলো বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করে দেখা হবে। সাধারণত এটা যদি বিস্ফোরক হতো, তাহলে বহুদিকে মানে তিন-চার দিকে যেতো। আর এই ঘটনায় গ্যাসের ভাঙা টুকরা ছাড়া আমরা অন্য কিছু খুঁজে পাইনি।

তবুও বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত হতে পুলিশের ‘বোম ডিসপোজাল ইউনিট’সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হবে। ঘটনাটিকে নাশকতা মনে হচ্ছে কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি জানান, এটা স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমরা দুয়েকদিন অপেক্ষা করি। বিস্ফোরণের লক্ষ্য ছিল- এদিকটা (বাড়ির উত্তর) এবং এটি একমুখী ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য অপেক্ষা করি। এরপর বিস্তারিত জানাতে পারবো।

এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এদিকে, রমনা থানার এস আই মো. আমেনা খানম গতকাল জানান, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি। কোনো ভিকটিম না আসায় মামলা হয়নি। তবে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করবে এবং তা প্রক্রিয়াধীন আছে।