কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে সরকারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একেকজনের একেক বক্তব্যে দেশবাসী বিভ্রান্ত ও হতাশ। টাঙ্গাইলের একজন কৃষক আগুন দিয়ে খেতের ধান পুড়িয়ে দেওয়ার পর আশা করা গিয়েছিল, সরকারের নীতিনির্ধারকদের চৈতন্যোদয় হবে। কিন্তু খোদ খাদ্যমন্ত্রী যেভাবে ওই কৃষককে উপহাস করেছেন, তাতে মনে হয় কৃষকের দুঃখ–কষ্ট মন্ত্রীদের স্পর্শ করে না। কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া না-পাওয়ায় তাঁদের কিছু আসে যায় না।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাল রপ্তানি করা হবে। কৃষিমন্ত্রীও এর আগে একই রকম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু তা তো সময়সাপেক্ষ। কবে নয় মণ ধান পুড়বে আর রাধা নাচবে! এই মুহূর্তে কৃষক খোলাবাজারে ধানের যে দাম পাচ্ছেন, তা উৎপাদন খরচের অনেক কম। এক মণ ধান উৎপাদন করতে খরচ হয় এক হাজার টাকার বেশি। অথচ খোলাবাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকায়। ফলে কৃষকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বেড়েছে।
সংকট উত্তরণে খাদ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি চাল আমদানি বন্ধের সুপারিশ করেছে। আমরাও মনে করি, এই মুহূর্তে সরকার চাল আমদানি বন্ধ করলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর খোলাবাজারে চালের দাম বাড়লে চালকলের মালিকেরাও বেশি দামে ধান-চাল কিনতে বাধ্য হবেন। প্রতিবছরই মৌসুমের শুরুতে ফড়িয়া দালালদের পাশাপাশি একশ্রেণির চালকল মালিকও কৃষকদের ঠকানোর জন্য নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে সরকারও সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল না কিনে কিনছে চালকলের মালিকদের কাছ থেকে। এতে ফড়িয়া-দালাল ও চালকলের মালিকদের পোয়াবারো হলেও বিপদে পড়েন কৃষকেরা। সরকার-নির্ধারিত দামে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার কথা থাকলেও সরকারের খাদ্য বিভাগ সেটি চালকলের মালিকদের কাছ থেকে কিনে থাকে এই অজুহাতে যে কৃষকের দেওয়া ধান যথেষ্ট শুকানো থাকে না। ফলে এসব ধান গুদামজাত করা যায় না।
সরকারের নীতনির্ধারকেরা যখন দেশবাসীকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করছেন, তখন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসন একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। জেলার তালিকাভুক্ত কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি এক হাজার মণ ধান কিনছে তারা; যদিও ধান কেনার দায়িত্ব তাদের নয়। এ কাজ করার কথা স্থানীয় খাদ্য বিভাগের। কুষ্টিয়ায় খাদ্য বিভাগের অনুরোধেই জেলা প্রশাসন কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনায় সহায়তা করছে। জেলার সব ইউনিয়ন থেকে ২৫ জন করে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনছে তারা।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। গতকালের পত্রিকার খবর, কুষ্টিয়ার দেখাদেখি নাটোরের জেলা প্রশাসনও সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনছে। কিন্তু এটি তো নিয়ম নয়। খাদ্য বিভাগের কাজটি করতে হবে। যখন সরকার ধান–চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখনই খাদ্য বিভাগকে উদ্যোগী ভূমিকা নিলে হয়তো জেলা প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হতো না। এ ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট নীতি থাকতে হবে। যে ধান চালকল মালিকেরা কৃষকের কাছ থেকে কিনতে পারবেন, সেই ধান কেন খাদ্য বিভাগ কিনতে পারবে না?
সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ নির্দেশনা দেওয়া যে তাঁরা যেন সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনেন। ফড়িয়া দালাল ও চালকল মালিকদের কাছে কৃষকদের জিম্মি না করেন। কাজটি যত দ্রুত শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল। সূত্র: প্রথম আলো।