করোনাভাইরাস: বাংলাদেশে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয় এড়াতে সরকারের প্রস্তুতি কতটা?

বিবিসি বাংলা : কয়েকদিন আগে জাতিসংঘ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ডব্লিউএফপি বলেছে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হতে পারে, এবং এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে। এর পেছনে কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং অনেক দেশ খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার আশংকাকে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন চলছে বোরো ধানের মৌসুম। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে ইতিমধ্যে সারাদেশে ধান কাটা শুরু হয়েছে।

এর আগে হাওর অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকের অভাবে ধান কাটা নিয়ে এক ধরণের জটিলতা দেখা দিলেও পরে, সরকার অন্য জেলা থেকে শ্রমিক আসার ব্যবস্থা করলে, সে সংকটের সুরাহা হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন ও মজুদের কী অবস্থা?

সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
বাংলাদেশে এ বছর খাদ্যশস্যসহ অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এখন বাংলাদেশে খাদ্য মজুদ পর্যাপ্ত আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

“বোরো আমাদের প্রধান ফসল। এ বছর আমাদের কৃষিপণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি চার লক্ষ টন। ফসলের অবস্থা এ বছর খুবই ভালো, প্রকৃতিও খুবই সহায়ক ছিল, যে কারণে আমরা আশা করছি, যদি না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, এবার বাম্পার ফলন হবে।”

এরপর আসবে আউশ ফসল, যেখানে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ লক্ষ টন। এর বাইরে অন্য দানাশস্য, সবজি ও ফলের উৎপাদনও এখন পর্যন্ত ভালো বলে তিনি জানিয়েছেন।

এদিকে, হাওড় অঞ্চলে ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে ধান কাটা, নতুন মৌসুমে ফসল রোপণ এবং ফসল বাজারজাতকরণ নিয়ে সরকার আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে।

“আমরা বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় আছি, যে কারণে প্রস্তুতিও বড় আকারে নেয়ার চেষ্টা করেছি। হাওড় এলাকায় ধান কাটার জন্য অন্য জেলা থেকে কৃষি শ্রমিকদের যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিল, সেটা সমাধান করা হয়েছে।

এছাড়া চারশোর মত ধান কাটার মেশিন, চার-পাঁচশো রিপার (মাড়াই করার যন্ত্র) দেয়া হয়েছে। সব মিলে ধান কাটার পরিস্থিতি সন্তোষজনক।”

কিন্তু ভালো উৎপাদনের সম্ভাবনার পরেও, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের মধ্যে ধান বাজারজাত করা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।

তবে, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের ঘাটতি হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বীজ ও সার আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে।

কৃষি উৎপাদন ও মজুদের কী অবস্থা?
সরকার বলছে, করোনাভাইরাসের পরবর্তী সময়ে চাহিদা সামাল দেয়ার জন্য সরকার এবার বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে গত বারের চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকার এবার ২১ লাখ টন খাদ্যশস্য কিনবে, যেখানে গত বছর ১৬ লাখ টন কেনা হয়েছিল। খাদ্য সচিব নাজমানারা বেগম বিবিসিকে বলেছেন, রোববার অর্থাৎ ২৬শে এপ্রিল থেকে এই কার্যক্রম শুরু হচ্ছে, চলবে ৩১শে অগাস্ট পর্যন্ত।

“গত আমন মৌসুমে এক কোটি ৫৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এবং বোরোতে আমরা দুই কোটি মেট্রিক টনের বেশি ফলন আশা করছি। যে কারণে খাদ্য সংকট বা দানা জাতীয় খাবারের সংকট হবে না।”

কিন্তু এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার বাড়ার ফলে একটা বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায়, সরকার ত্রাণ বিতরণ শুরু করেছে।

সেজন্য সরকারী মজুদের কিছুটা কমে গেলেও, বোরো ফসল ওঠার পর তা পূরণ হয়ে যাবে বলে মনে করেন সচিব। এ মৌসুমে আট লক্ষ মেট্রিক টন ধান, সাড়ে ১১ লক্ষ মেট্রিক টন চাল এবং ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম কিনবে সরকার। সরকারী খাদ্য গুদামে মজুত গড়ে তোলার জন্য খাদ্যশস্য সংগ্রহের কাজ খাদ্য অধিদফতরই করে থাকে। খাদ্য সচিব বলেছেন, আগামী ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে চালকল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করবে সরকার, যাতে ৭ই মে থেকে তারা সরকারকে চাল দেয়া শুরু করতে পারে।

এদিকে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই দুই লাখ মেট্রিক টন গম কেনার সমঝোতা হয়েছে, এবং জুলাই মাসের মধ্যে সে গম এসে পৌঁছাবে দেশে। এর আগে রাশিয়া গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। খাদ্য সচিব নাজমানারা বেগম বলছেন, রাশিয়ার ঘোষণার আগেই জি-টু-জি অর্থাৎ দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল, ফলে গম যথাসময়ে আসবে।

চ্যালেঞ্জিং হবে বাজার ব্যবস্থাপনা
এদিকে বিশ্লেষকেরা বলছেন, কোন দেশের খাদ্য পরিস্থিতি কেবলমাত্র উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এর সঙ্গে কৃষকের ন্যায্য মূল্য পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতাও আবশ্যক বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, এখন যেহেতু বিশ্বব্যাপী একটি বিশেষ পরিস্থিতি, সে কারণে বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারকে দক্ষতা দেখাতে হবে।

“এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্য উৎপাদন এবং মজুদে হয়ত সমস্যা নেই, কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনাটাই বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। পরিস্থিতি মোকাবেলার সাফল্য নির্ভর করবে বাজার ব্যবস্থাপনা ক্রুটিমুক্ত থাকার ওপর।”

“এক্ষেত্রে কৃষিপণ্যের মূল্য ও মজুদ নিয়ে কারসাজি, অন্যায়ভাবে বাজারকে প্রভাবিত করা, কৃত্রিম সংকট তৈরি—এ ধরণের কোন অব্যবস্থাপনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক হতে হবে।”

অধ্যাপক হক বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে যেহেতু দেশে এবং বিদেশে প্রচুর মানুষ চাকরি হারাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে সাধারণ প্রাক্কলনের বাইরে সরকারকে প্রস্তুতি রাখতে হবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
শীর্ষনিউজ/এসএসআই