একাত্তরে বাংলাদেশ যেদিন মুক্ত-স্বাধীন হয়, সেই ১৬ ডিসেম্বর তার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে চার মাস। সুনামগঞ্জের আদালতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা হয়েছে সেদিনের সেই শিশুর বিরুদ্ধে! একাত্তরে জন্ম নেওয়া শিশু কীভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়, তা নিয়ে তোলপাড় সুনামগঞ্জজুড়ে। গত মঙ্গলবার স্থানীয় আমল গ্রহণকারী আদালতের বিচারক এই অভিযোগ ঢাকার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাহিরপুরের শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের দুধের আওটা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. সুজাফর আলী এই অভিযোগ করেছেন। এতে তিনি সমকালের তাহিরপুর প্রতিনিধি ও উপজেলা প্রেস ক্লাব সভাপতি আমিনুল ইসলামকে (৪৮) অভিযুক্ত করেন। তাহিরপুরের আমল গ্রহণকারী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শুভজিৎ পাল এই অভিযোগ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তবে বাদীপক্ষ এই বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে যে, মামলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী (পিপি) শামছুন নাহার বেগম শাহানা বলেন, এমন কোনো মামলার কথা জানি না। যে আদালতের কথা বলা হচ্ছে, তার বিচারক নিশ্চয় অভিযোগ স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন। অভিযুক্তের বয়সের ব্যাপারে তিনি বলেন, যিনি অভিযোগ করেছেন তাকেই এটি প্রমাণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তের বয়স সত্যিই মাত্র কয়েক মাস হলে মামলা এমনিতেই খারিজ হওয়ার কথা।
সুজাফর আলী অবশ্য তার অভিযোগে জানিয়েছেন, উপজেলার ভাটি তাহিরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মালিকের ছেলে আমিনুল ইসলামের বয়স বর্তমানে ৬৩। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমিনুল ইসলাম একজন যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদল, চাঁদাবাজ, আলশামস, পরধন-পরনারী লোভী ও দেশবিরোধী।’ আমিনুলের বাবা উপজেলার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। তার দাবি, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় আমিনুল শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
অভিযুক্ত আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকতার পাশাপাশি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এর আগে ১৯৮৮ সাল থেকে টানা দু’দফা তিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের আসন্ন নতুন কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সুজাফর আলীকে দিয়ে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে এখনও প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয়। তার মতে, সামনে তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র তার সম্মানহানির জন্য নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তিনি জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জন্ম। দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন তার বয়স চার মাস ১৬ দিন। তখন কীভাবে যুদ্ধাপরাধ করা সম্ভব?
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, আমিনুল ইসলামের জন্ম ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। তবে মামলার বাদী সুজাফর আলী বলেন, তাকে যারা তথ্য দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু প্রমাণ করবেন। আমিনুল বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটু কথা বলেছেন, এমন অভিযোগ করে সুজাফর জানান, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি এই ‘মামলা’ করেছেন- অযথা হয়রানির জন্য কিছু করেননি। কারও ইন্ধনেও তিনি এ মামলা করেননি।
এসব অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সুজাফর আলী মুঠোফোনে জানিয়েছিলেন, কাগজপত্র দেখে ঘণ্টাখানেক পর বিস্তারিত বলবেন। তবে তিনি আর যোগাযোগ করেননি। এমনকি যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকেও আর পাওয়া যায়নি। এদিকে তাহিরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অনুপম রায় বলেন, আমিনুল ও তিনি ১৯৮৬ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর তারা দু’জনেই উপজেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তাহিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের দুইবারের সাবেক কমান্ডার রইছ আলী জানান, তিনি টেকেরঘাট এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সে সময় সুজাফর আলীকে তিনি কখনও দেখেননি। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় সুজাফরের নাম কীভাবে এসেছে, তাও তার জানা নেই। যে কারণেই হোক না কেন, আমিনুল ইসলামকে হয়রানি করার জন্যই সুজাফর এ মামলা করেছেন বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
মুক্তিযোদ্ধা রইছ আলী বলেন, এলাকার মানুষ হিসেবে সুজাফর আলী ও আমিনুল দু’জনকেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। আমিনুলের বয়স এখনও পঞ্চাশ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে কয়েক মাসের বাচ্চা ছিল। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এমন ভিত্তিহীন মামলা করে তাদের সবাইকে বিব্রত ও অসম্মানিত করা হয়েছে।
নিন্দা ও প্রতিবাদ : আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে তাহিরপুর উপজেলা প্রেস ক্লাব। গত বুধবার দুপুরে অস্থায়ী কার্যালয়ে প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি ও যায়যায়দিন প্রতিনিধি বাবরুল হাসান বাবলুর সভাপতিত্বে জরুরি সভায় মিথ্যা মামলার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তৃতা করেন প্রেস ক্লাব উপদেষ্টা রমেন্দ্র নারায়ণ বৈশাখ, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ইত্তেফাক প্রতিনিধি আলম সাব্বির, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মানবজমিন প্রতিনিধি এমএ রাজ্জাক, অর্থ সম্পাদক ও ভোরের কাগজ প্রতিনিধি এসএম সাজ্জাদ শাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংবাদ প্রতিনিধি কামাল হোসেন, নয়াদিগন্ত প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া, সিলেট ভয়েস২৪ডটকম প্রতিনিধি আবির হাসান মানিক, সুনামগঞ্জের সময় প্রতিনিধি সামায়ুন কবীর, মুবিনুর মিয়া, রোমান আহমেদ তুষা প্রমুখ।