উদ্ভাবনের বালিশ এবং উন্নয়নের তত্ত্ব

নিশাত সুলতানা: নানা উদ্ভাবনের জন্মভূমি এই বাংলাদেশ। প্রতিদিন চলতি পথে, মাঠে-ময়দানে, হাটে-বাজারে, অফিসে-আদালতে নানা ধরনের উদ্ভাবন আর সৃজনশীলতা দেখেশুনে আমাদের ঘোর যেন কাটতেই চায় না। এক উদ্ভাবনের বিস্ময় কাটতে না–কাটতেই আরেক উদ্ভাবন দরজায় কড়া নাড়ে। নানা ধরনের উদ্ভাবনের স্বকীয়তা ও অভিনবত্বে আমাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

কদিন থেকেই আমরা বুঁদ হয়ে আছি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের গ্রিন সিটি প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বালিশ–কাহিনি নিয়ে। প্রকল্পটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিরল প্রজাতির ১৩২০টি বালিশ কেনা হয়েছে; যার প্রতিটির মূল্য প্রায় ৬ হাজার টাকা। এই অভিজাত শ্রেণির প্রতিটি বালিশ ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ হয়েছে ৭৬০ টাকা। আমাদের ঘুমের অপরিহার্য অনুষঙ্গ এই বালিশ এত দিন কিন্তু অবহেলিতই ছিল। বালিশের গুরুত্ব প্রতিদিনের অভ্যাসবশত আমরা অনেক সময় উপলব্ধিই করি না। অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকল্পটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের, যাঁরা বালিশের মূল্য নিজেরা বুঝেছেন এবং দেশবাসীকে বুঝিয়েছেন।

বনের রাজা ওসমান গণি বালিশের আরেক গুণ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর আগে কেউ কি কখনো জানত টাকার কমনীয় গুণের কথা। ওসমান গণি টাকার কমনীয়তা অনুভব করে তাকে স্থান দিয়েছিলেন বিছানার তোশকে ও বালিশে। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন দিনের পর দিন। যদিও তাঁর শেষ ঠাঁই হয়েছে লালঘরে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত তাঁদের এত উদ্ভাবনের ভার আমরা নিতে পারব তো?

শুনেছি, ঘুষের আদান–প্রদানের মাধ্যমে কাজ হাসিল করার প্রক্রিয়াটি নাকি সেই ব্রিটিশ শাসন আমলেই ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। সেই যে শুরু হলো, তারপর যুগের পর যুগ আর বছরের পর বছর ধরে চলছে ঘুষ আদান-প্রদান শিল্পের চর্চা। কখনো টেবিলের ওপর দিয়ে, কখনোবা নিচ দিয়ে, কখনো ফাইলের ফাঁক গলে কিংবা কখনো বড় কর্মকর্তার স্ত্রীর গলার হার হয়ে নানাভাবে হয়ে চলে আসছে এই শিল্পের চর্চা। কিন্তু সারা বিশ্বে কেউ কি কখনো শুনেছে কেজি মেপে ঘুষ লেনদেন তত্ত্ব! এই তো কিছুদিন আগে একটি অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তার কেজি মেপে ঘুষ লেনদেনের এই সাংকেতিক ভাষা। গণনার একক ‘লাখ’কে পরিমাপের একক ‘কেজি’ উপাধি দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত সাংকেতিক ভাষা আবিষ্কারের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনের এই অভিনব কৌশল রীতিমতো বিস্ময়জাগানিয়া এবং স্বীকৃতির দাবিদার।

অন্যদিকে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে কিংবা বাতাসে উড়ে দেড় লাখ টন কয়লা গায়েব হবার ঘটনা কে কবে কোথায় শুনেছে? এ ঘটনা না ঘটলে প্রকৃতিও হয়তোবা তার নিজের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করত। দেড় লাখ টন কয়লা সরাতে নাকি রোজ এক হাজার ট্রাকের পনেরো বছর প্রয়োজন। অথচ এই কঠিন কাজটি প্রকৃতি নীরবে করে গেছে কোনো স্বীকৃতির আশা না করেই। কয়লা গায়েবের ঘটনা প্রকাশিত হবার পর প্রকৃতির এই উদারতা আর সক্ষমতা প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসেন বড়পুকুরিয়ায় খনির দায়িত্বে থাকা কতিপয় প্রতিভাবান কর্মকর্তা। তাঁদের উদ্ভাবনী আর সুবিবেচিত পর্যবেক্ষণে প্রকৃতি আরেকবার জানতে পেরেছে তার সক্ষমতা। অন্যদিকে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তারাও পিছিয়ে থাকেননি উদ্ভাবনের অভিনবত্বে। তাঁরা উদ্ভাবন করেছিলেন প্রায় ৫৬ কোটি টাকা মূল্যের ৩ লাখ ৬০ হাজার টন মূল্যবান পাথর নাকি কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই মাটির নিচে দেবে গেছে। সীমাহীন উদ্ভাবনী প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তিবর্গের এসব তত্ত্ব ও তথ্যকে যদি স্বীকৃতি প্রদান না করা হয়, তবে অচিরেই তা মাটি চাপা পড়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

মাছ-মাংসে রং করে, চাল পলিশ করে, চিংড়ি মাছে জেলি ঢুকিয়ে, কবুতরের মুখে জাদুকৌশলে খাবার পুরে, চাল-ডালের সঙ্গে কাঁকড় মিশিয়ে কত অভিনব কায়দাতেই না চলছে উদ্ভাবনী প্রতিভার চর্চা। হাঁড়িতে দিনের পর দিন দুধের শিশুকে আটকে রেখে তাকে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষার পুঁজি বানানোর বিরল কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে এই দেশে। এসব বিরল প্রতিভার কাছে পরাজিত হয়ে ধূর্ত শিয়ালও ছাগল হয়ে পরিবেশিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্রদের খাদ্য হিসেবে।

বনের রাজা ওসমান গণির আগে কেউ কি কখনো জানত টাকার কমনীয় গুণের কথা। ওসমান গণি টাকার কমনীয়তা অনুভব করে তাকে স্থান দিয়েছিলেন বিছানার তোশকে ও বালিশে। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন দিনের পর দিন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত তাঁদের এত উদ্ভাবনের ভার আমরা নিতে পারব তো?

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo.com

সূত্র: প্রথম আলো।