প্রভাষ আমিন: নির্বাচনে ইভিএম দরকার কি দরকার না, এই প্রশ্নের জবাবে আপনারা কে, কী বলবেন জানি না; আমি বলবো দরকার। প্রযুক্তি যেভাবে আমাদের সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে, তাতে একদিন না একদিন নির্বাচনী ব্যবস্থাকেও প্রযুক্তির কাছে যেতে হবে।
তবে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম পদ্ধতি এখনও পরীক্ষিত নয়। এমনিতে মেশিন যদি ভালো হয়, ইভিএম’এ ভোট নিলে তা দ্রুত ও নির্ভুলভাবে গণনা করা সম্ভব। কোনো ভোট নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই। ব্যালট পেপারে সিল মারার সুযোগ নেই। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের সুযোগ নেই। আঙ্গুলের ছাপ না দিলে মেশিন খুলবে না বলে মৃত চাচীর পক্ষে ভোট দিতে এসে চাচার সাথে দেখা না করে পরপারে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
এতগুলো সুবিধা থাকায় যে কারোর চোখ বন্ধ করে ইভিএম’র পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ দল এবং মানুষ ইভিএম’র বিপক্ষে। যারা ইভিএম’র বিপক্ষে তারা বিশেষ করে বিএনপি বলছে, ইভিএম আনা হচ্ছে ডিজিটাল কারচুপির জন্য। তাদের দাবি, ইভিএম দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আমি ইভিএম’এর পক্ষে, আপনি বিপক্ষে থাকতে পারেন। কিন্তু ইভিএম হলে কারচুপি হবে এটা শুনে খুব হাসি পেয়েছে। ইভিএম হলে কারচুপি হবে। তার মানে ইভিএম না হলে কারচুপি হবে না। আমরা ৭৯ এর নির্বাচন দেখেছি, জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ/না ভোট দেখেছি, ৮৮ এর নির্বাচন দেখেছি, ৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দেখেছি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেখেছি, সাম্প্রতিক খুলনা-গাজীপুরেও নির্বাচন দেখেছি।
এসব নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে কি হয়নি?
এসব নির্বাচনে কিন্তু ইভিএম ছিল না। তার মানে ইভিএম’র সাথে কারচুপির কোনো সম্পর্ক নেই। কারচুপি করতে চাইলে ইভিএম ছাড়াও করা যায়। বরং ইভিএম ছাড়া কারচুপি সহজ। হোন্ডা, গুণ্ডা, ডাণ্ডা; নির্বাচন ঠাণ্ডা।
ইভিএম’এ কারচুপি করতে হলে প্রযুক্তিবান্ধব মাস্তান ও হ্যাকার ভাড়া করতে হবে।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বল্প পরিসরে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে বড় কোনো অভিযোগ ছাড়াই। তবে বিশ্বের অনেক দেশে ইভিএম ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অনেকে গ্রহণ করেও পরে বাদ দিয়েছে। সমস্যা থাকলে তার সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। ট্রাবলশ্যুট করেই একটা ব্যবস্থা নির্ভুলত্বের দিকে এগিয়ে যায়। নিশ্চয়ই একদিন সমস্যামুক্ত ইভিএম পাওয়া যাবে। যাতে চট করে ভোট নিয়ে নেয়া যায়।
ভয় পেয়ে প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকার চেয়ে বোকামি আর কিছু নেই। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিনা পয়সায় সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ না নেয়ায় বাংলাদেশের ডিজিটালযাত্রা ৫ বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। অন্য সবকিছুর মত প্রযুক্তির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। যেমন ফেসবুকে ছড়ানো গুজবে দেশে অনেক লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে। তাই বলে কিন্তু ফেসবুক বন্ধ করা হয়নি। ইভিএম খারাপ তাই এটা নেয়া যাবে না, এরচেয়ে বড় অবিমৃষ্যকারিতা আর নেই।
বলছিলাম কারচুপির কথা। কারচুপির জন্য আসলে যন্ত্র নয়, যন্ত্রের পেছনের মানুষ দায়ী। ইভিএম তো আর নিজে থেকে কারচুপি করে কোনো দলকে জিতিয়ে দেবে না, পেছনের মানুষটা যেমন নির্দেশনা দেন, তেমনই কাজ করবে। মানুষের মনে দুষ্টামি থাকলে তা ঠেকানোর সাধ্য কোনো যন্ত্রের নেই।
শুরুতে যে প্রশ্নটি করেছিলাম, তা একটু বিস্তৃত করে দেই- আগামী নির্বাচনে ইভিএম দরকার কি দরকার না? এই প্রশ্নের জবাব আমি নিছক হ্যাঁ বা না’তে দেবো না। সঠিক উত্তরটি হলো, সম্ভব নয়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নির্বাচন। তফসিল ঘোষণার আর মাস দুয়েক বাকি। এই সময়ে এমনকি সব দল চাইলেও আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সম্ভব নয়। একাদশ নির্বাচনের মত মহাগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন যখন দুয়ারে, তখন নির্বাচন কমিশনের টেনশনে ঘুমাতে পারার কথা নয়, সেই সময়ে তারা কেন ইভিএম’র মত একটি ঘুমন্ত বিতর্ককে খুঁচিয়ে তুলছে; আমার মাথায় ঢুকছে না। নির্বাচন কমিশন বারবার বলছিল, সব দল না চাইলে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না। নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৩টি দল ইভিএম ব্যবহার নিয়ে মতামত দিয়েছিল। বিএনপিসহ ১২টি দল ছিল বিপক্ষে। আওয়ামী লীগসহ ৭টি দল ছিল পক্ষে। তবে যারা পক্ষে ছিল, তারাও কিন্তু এবারই করতে হবে এমন কোনো চাপ দেয়নি। তাহলে নির্বাচন কমিশন কেন অসময়ে এ অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে নিজেদের জড়াতে চাইছে?
একটা গল্প আছে, বাধা গরু নাকি দড়ি ছিড়ে বিপদের পানে ছুটে যায়। নির্বাচন কমিশনকে তেমন দড়ি ছিড়া মনে হচ্ছে আমার কাছে।
গরুর আরেকটি গল্প আছে, লেজে গোবরে। গরু লেজে গোবর মাখিয়ে নিজের সারা শরীর এবং আশপাশকেও নোংরা করে।
নির্বাচন কমিশন তেমন লেজে গোবরে অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের উচিত, কোনো দিকে না তাকিয়ে আগামী নির্বাচনকে পাখির চোখ করা এবং সবাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। কিন্তু তা না করে তারা আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
অবস্থা দেখে আমার জীবনানন্দে আশ্রয় খুঁজতে মন চাইছে, তবু জোসনায় দেখিল সে কোন ভুত…।
ইভিএম ব্যবহার করার আগে বড় দলগুলোর ঐকমত্য তো লাগবেই, লাগবে প্রশিক্ষিত জনবল। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই বিষয়গুলো আবার ইভিএম’র মত যন্ত্রে পাওয়া যাবে না। আস্থা আপনি সুইচ টিপলে পাবেন না। এটা অর্জন করতে হয়। যেমন আপনি যদি দ্বাদশ নির্বাচনের ইভিএম ব্যবহার করতে চান, তাহলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে এখন থেকে মানে একাদশ নির্বাচনের চার মাস আগে থেকে নয়; নির্বাচন পর থেকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
নির্বাচন কমিশন সারা বছর ঘুমিয়ে থেকে শেষ সময়ে জেগে উঠলে তো বিপদ।
বলছিলাম সম্ভাব্যতার কথা। ৩০ আগস্ট নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রেখে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এখন এটা মন্ত্রিসভায় যাবে। মন্ত্রিসভা অনুমোদন করলে সংসদে যাবে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে তো নির্বাচনের তফসিল চলে আসবে। ইভিএম নিয়ে বিতর্ক শুধু বাইরে নয়, নির্বাচন কমিশনেও গৃহদাহ শুরু হয়েছে।
৩০ আগস্টের বৈঠকে মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেছেন। তিনি লিখিত আকারে তার আপত্তি জানিয়েছেন। তার অনেকগুলো পয়েন্ট আছে। আমার বিবেচনায় সবগুলোই যৌক্তিক। তিনি বলেছেন, আমি ইভিএম চাই, তবে এই নির্বাচনে নয়। আমিও তার সাথে একমত। তবে মাহবুব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্টের পর অনেকেই বলছেন, তিনি বিএনপি সমর্থক। হতেই পারেন। সার্চ কমিটিতে মাহবুব তালুকদারের নাম দিয়েছিল বিএনপি। তাই বলে তিনি যৌক্তিক কথা বললেও তাকে রাজনীতিকরণ করা কোনো কাজের কথা নয়। কমিশনের বাকি ৪ জন পাগলামি করছে বলে মাহবুব তালুকদারকেও তাতে সামিল হতে হবে?
তবে নির্বাচন কমিশন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়েছে। আইন সংশোধন করার আগেই তারা ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। সেটার জন্যও একনেকের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের আগেই ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ট্রাস্ট ব্যাংক ইতিমধ্যে এলসি খুলেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর শতাধিক সুপারিশ আড়ালে রেখে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় নিয়েই নির্বাচন কমিশন এগুচ্ছে কেন, এ ব্যাপারে আমার দুটি ধারণা আছে। আমি নিশ্চিত আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না। তারপরও ইভিএম কেনা হবে। কারণ ৩ হাজার ৮২৯ কোটা টাকা, অনেক টাকা। কেনাকাটা মানেই কমিশন, লুটপাট। শেষ পর্যন্তু পুরো টাকাটাই জলে যাবে। সরকারকা মাল দরিয়া মে ঢাল। আমার ধারণা, আগামী নির্বাচনে যে ইভিএম ব্যবহার হবে না, এটা নির্বাচন কমিশনও জানে। তারা আসলে অন্য বিতর্ক বা ব্যর্থতা আড়াল করতে বা দর কষাকষিতে নিজেদের এগিয়ে রাখতেই ইভিএম ইভিএম খেলছে। তবে খেলনাটা একটু বেশি দামি এই যা। শেষ মুহূর্তে হয়তো বিএনপিকে বলা হবে, ঠিক আছে যান, আপনাদের দাবিই মানলাম। ইভিএম ব্যবহার হবে না। তবুও আপনারা নির্বাচনে আসুন।
যাই হোক, আগস্টের ৩০ তারিখে নির্বাচন কমিশনের ইভিএম বিতর্ক অপ্রয়েজনীয়, অপচয়মূলক, অসময়োচিত, অবিমৃষ্যকারী, অবাস্তব। একাদশ নির্বাচনের পর ইভিএম নিয়ে সবার সাথে বসুন, কথা বলুন, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো শুনুন, সমস্যা থাকলে সমাধান করুন, জনবলকে প্রশিক্ষণ দিন; যাতে দ্বাদশ নির্বাচন সবার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে ইভিএম ব্যবহার করা যায়।
প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com